Skip to main content

জহির রায়হানের জীবন ও কর্মে বাঙালি জাতীয়তাবাদ


  
‘গুরুমশাই,
অন্ধকারে কে দেখাবে মানচিত্রখানা?
মাথার মধ্যে দৃশ্য নানা,
স্মৃতির মধ্যে অজস্র ফুল,
তাঁর সুবাসেই দেশকে পাচ্ছি বুকের কাছে’
  • নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী /দেশ দেখাচ্ছে অন্ধকারে
স্মৃতিকে স্মরণে রেখে বুকের মধ্যে দেশকে অনুভব করা ও ক্ষণে ক্ষণে কথায়-কর্মে  তার প্রকাশ ঘটাতে পারা মানুষের সংখ্যা খুব কম- হাতে গোনা। জহির রায়হান সে রকম একজন। শুধু বাংলা চলচ্চিত্র নয় সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে তিনি দেখেছেন দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া বাঙালির কাঙ্ক্ষিত  মুক্তির স্বপ্ন।  বাঙালির ঐতিহ্য-চিন্তা-মনন-দুর্দশা-লিপ্সা নিপুণ তুলিতে যেমন এঁকেছেন উপন্যাস ও গল্পের খেরোখাতায়, তেমনি বন্দী করে রেখেছেন তার চলমান ছবি সেলুলয়েডের ফিতায়।  বাঙালির স্বাধীনতার জন্য তিনি দেশান্তর হয়েছিলেন, হন্যে হয়ে বিশাল ভারতের বিশাল জনসমুদ্রে হেঁটে বেড়িয়েছেন, আন্তর্জাতিক সমাবেশে জনমত গড়ে তুলেছেন এবং ঘরে অসুস্থ স্ত্রী ও পরিবারকে অভুক্ত রেখে উপার্জিত অর্থ বিলেয়ে দিয়েছেন ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য।  বাংলা চলচ্চিত্রের নান্দনিক স্থপতি হিসেবে বাংলা সংস্কৃতিকে যেমন তিনি দিয়েছেন সুদৃঢ় ভিত্তি, তেমনি গৌরবময় অবদান রেখে গেছেন মহান ভাষা আন্দোলনে, প্রগতিশীল রাজনীতি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সাংবাদিকতা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে। অবিভক্ত ভারতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সূচনা হলেও তার পরিবর্ধন ও উন্নয়ন ঘটেছে ভাষা আন্দোলন ও তার পরবর্তী সময়ে। জহির রায়হানের জন্ম, বেড়ে উঠা ও কর্মের জন্য দৌড়ঝাঁপ এ সময় জুড়েই।  বাঙালির মুক্তি আন্দোলন তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রভাব ফেলেছে তাই তার সমগ্র জীবন ও কর্মে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
বাংলা সাহিত্য, সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ব্জহির রায়হান জন্মগ্রহণ করেন  তৎকালীন ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার মজুপুর গ্রামে ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট।  তাঁর প্রকৃত নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ, ডাক নাম জাফর এবং কমরেড মণি সিংহ প্রদত্ত রাজনৈতিক নাম রায়হান। জহির রায়হানের পিতা হাবিবুল্লাহ, বিভাগপূর্বকালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা এবং পরে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। তাঁর মা  সুফিয়া খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী। পিতা-মাতার অষ্টম সন্তানের মধ্যে জহির রায়হান ছিলেন তৃতীয়। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা শহিদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১) ছিলেন রাজনিতিক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।  
তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘ওদের জানিয়ে দাও’ ছাপা হয় ১৯৪৯ সালে ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায়। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে জগন্নাথ কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক পাশ করেন। ১৯৫৭ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি এ জে  কারদারের সহকারী পরিচালক হিসেবে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র মাধ্যমে চলচ্চিত্রের জগতে আগমন করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি  ‘কখনো আসে নি’ মুক্তি পায় ১৯৬১ সালে। তাঁর পরিচালিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হল- সোনার কাজল  (১৯৬২), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (১৯৬৪), বাহানা (১৯৬৫), বেহুলা (১৯৬৬), আনোয়ারা (১৯৬৭) ও  জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা আট- গল্প সংকলন সূর্যগ্রহণ (১৯৫৫), উপন্যাস  সাতটি শেষ বিকেলের মেয়ে, তৃষ্ণা (১৯৬২), হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৮), বরফ গলা নদী (১৯৬৯), আর কত দিন (১৯৭০) ও একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৭০)। তাঁর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলো হল স্টপ জেনোসাইড ( ১৯৭১), লেট দেয়ার বি লাইট (১৯৭০) ও এ স্টেট ইজ বর্ণ (১৯৭১)।
এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেন এক্সপ্রেস ও প্রবাহ নামের দুটি পত্রিকা।
উপন্যাসে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে মরণোত্তর  বাংলা একাডেমি পুরস্কার,  ১৯৭৭ সালে চলচ্চিত্র শিল্পে অবদানের জন্য একুশে পদক এবং সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য  ১৯৯২ সালে মরণোত্তর  স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি লাভ করেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪) ও নিগার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার পুরস্কার (১৯৬৫)।
জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হবার পর তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন, যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান ভাইয়ের সন্ধানে মিরপুরে যান এবং সেখান  থেকে আর ফিরে আসেন নি। মিরপুর ছিল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বিহারি অধ্যুষিত এলাকা এবং এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সেদিন বিহারি ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশিদের ওপর গুলি চালালে তিনি নিহত হন। কিন্তু তাঁর লাশ খুঁজে না পাওয়ায় তাঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ কী
ল্যাটিন শব্দ ‘Natio’ এর অর্থ জাত বা বংশ যা থেকে উৎপত্তি ঘটেছে Nationalism বা জাতীয়তাবাদ শব্দটির। জাতীয়তাবাদ একটি অবস্থা বা চেতনা কোন লোককে তার নিজের দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থকে তুলে ধরতে পক্ষাবলম্বন করতে এবং তার জন্য কাজ করতে প্রলুব্ধ করে। জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা বুঝি একটি রাজনৈতিক শক্তি। শক্তিটা মানুষের মনে প্রোথিত হয় এবং তাহলে জনগণ একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে সমইচ্ছার ভিত্তিতে বসবাস করার সুযোগ পায়।  অর্থাৎ কোন জাতির মধ্যে যখন তাঁর স্বকীয় সংস্কৃতি-রীতি-আচার-ইতিহাসের চর্চা প্রবল ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, তখন সেখানে জাতীয়তাবাদের বীজ উপ্ত হয়। কেন তা হয়, বলে দিচ্ছেন ডঃ নেহাল করিম, ‘ জাতীয়তাবাদ এমন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যার ব্যাপ্তি নির্ভর করে বিদেশিদের বিরুদ্ধে জমে ওঠা দুঃখ-দুর্দশার সমষ্টির উপর’। বলা চলে, বিচ্ছিন্নতা বা বঞ্চনাবোধ থেকে কোন নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত বা ধর্মীয় পরিচয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ  মানবগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদের চেতনার জন্ম হয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদ আক্রমণকারীর  নয়, আক্রান্তের অনুভব’। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ কখনও সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয় নি। ইংরেজ শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে এ সম্প্রীতি নির্মূলের চেষ্টা চালানো হয় বার বার। সৃষ্টি হয় হিন্দু- মুসলমান দ্বন্দ্ব। এক সময় তা হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়ে  উপমহাদেশের মানুষকে বিভক্ত করে দিল, যার সুফল পেতে থাকল ইংরেজ সরকার।  
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষও ঘটে ঔপনিবেশিক আমলে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে। এক ভাষা ও সংস্কৃতির একদল মানুষ দীর্ঘ সংগ্রামে একত্রে আনতে সক্ষম হয় বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে। সেখান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শুরু। কিন্তু ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা কিংবা তারও আগে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা দুই ধরনের জাতীয়তাবাদের ধারক- বাহক রূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে; যদিও কংগ্রেসের মধ্যে কিছুটা উদারতা ছিল অন্যান্য সম্প্রদায়ের ব্যাপারে। এক সময় এদের অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে চলে যায়। মুসলিম জাতীয়তাবাদের নেতা মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ’র দ্বিজাতি তত্ত্ব ও লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে মুসলিম জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালের মধ্যরাতে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ  ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।  এর পূর্ব অংশ বাংলা একটি প্রদেশ হিসেবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পূর্ব  পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়।  মূল পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু শুরু হতেই পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানের এলিটদের হাতে ন্যস্ত ছিল। ফলস্বরূপ, পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছড়ি ঘুরাচ্ছিল। সমস্ত অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণ কথা বলতে গিয়ে সবাই এক প্লাটফর্মের যাত্রী হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় বাঙালি স্বাজাত্যবোধ ও তার পরিণাম গণ আন্দোলন ও মুক্তির আকুতি।
বাঙালির মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রাম হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির অধিকার সচেতনতার  প্রথম ধাপ; পর্যায়ক্রমে যা বিকশিত হয়ে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ছয় দফা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিরোধী সংগ্রাম, গণ অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্মেষ ঘটায়।
বাংলা ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে জাতীয় এ ঐক্যের নামই বাঙালি জাতীয়তাবাদ।   
প্রেক্ষাপট
জহির রায়হানের জাতীয়তাবাদী মানস গঠনে সময়ের দায় ছিল অনেক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পরই তাঁর জন্ম যখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনে নানা ভাবে নিপীড়নের শিকার। শৈশবে প্রত্যক্ষ করেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব, ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৪৭ সালে ‘ভারত ভেঙে ভাগ করা’।
তদুপরি, পরিবার ও সমাজও তাঁর মানস গঠনে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। জহির রায়হানের মাতা সুফিয়া কামালের পিতৃকুল ছিল তালুকদার। প্রভাবশালী এ পরিবার তৎকালীন জাতীয়তাবাদী ও স্বদেশি আন্দোলনের যুক্ত ছিল। জহির রায়হানের বড় ভাই সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন সক্রিয় বামধারার রাজনীতিক, যার চিন্তা চেতনা যা জহির রায়নের মানস গঠনে বেশ প্রভাব রেখেছিল। এছাড়াও শৈশবে কলকাতা চলে যাওয়া, দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে গ্রামে ফিরে আসা ও মানুষের সাথে মেশা তাঁর বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়তা করেছিল ব্যাপকভাবে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও জহির রায়হান
জহির রায়হান রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন শৈশবকাল থেকে। তিনি ছিলেন মুলত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত। একই সাথে বাঙালির দুঃখ- দুর্দশা-ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি অনুভব করেন আত্মিক টান, যা প্রকাশ হয়েছে জীবনভর কর্মকাণ্ডে। চারবার কাবারাস করেছেন, দেশের মুক্তির জন্য বিধ্বস্ত গ্রামে ঘুরেছেন, ঘরে অসুস্থ স্ত্রী ও অভুক্ত পরিবারকে বাদ সিনেমায় উপার্জিত অর্থ বিলিয়ে দিয়েছেন শরণার্থীদের মধ্যে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির সংগ্রামী অভিযাত্রাকে কেবল তিনি আলো হাতে পথই দেখান নি ইতিহাসের বাঁকগুলো বাঙময় হয়ে আছে তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্মে।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জহির রায়হান সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ঐ মাসের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সরকার ঢাকায় মিছিল, ধর্মঘট, জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। সংগ্রামী ছাত্রসমাজ এই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ জনের খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হয়। প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলেন জহির রায়হান। সেই দশজনের মিছিল থেকে জহির রায়হান গ্রেফতার হন এবং পরে মুক্তি পান। এ সম্পর্কিত  বাস্তব ঘটনাগুলো ফুটে উঠেছে তাঁর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ উপন্যাসের তসলিম চরিত্রের মধ্য দিয়ে।
জহির রায়হান ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির ঐ দিনের স্মৃতিচারণ করেন তাঁর নিকটাত্মীয় সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের কাছে, ‘ ছাত্রদের গ্রুপে ভাগ করা হলো। আমি ছিলাম দশজনের ভেতর। .... ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। কিন্তু প্রথম ব্যাচে কারা যাবে? হাত তুলতে বলা হল। অনেক ছাত্র থাকা সত্ত্বেও হাত আর ওঠে না। কারণ ক্যাম্পাসের বাইরে পুলিশ বন্দুক উঁচিয়ে পজিশন নিয়ে আছে। ভাবখানা এই যে, বেরুলেই গুলি করবে। ধীরে ধীরে একটা- দুটো হাত উঠতে লাগলো। গুনে দেখা গেল আটখানা। আমার পাশে ছিল ঢাকা কলেজের একটি ছেলে। আমার খুব বাধ্য ছিল। যা বলতাম, তাই করতো। আমি তুলে ওকে বললাম, হাত তোল। আমি নিজেই ওর হাত তুলে দিলাম। এই ভাবে দশজন হল’।
১৯৫২ সালের জুনে রাজনীতির কারণে আবার গ্রেফতার হয়ে তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে হটিয়ে যখন সামরিক শাসন ক্ষমতার গদিতে বসে, পূর্ব পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা তখন নতুন মাত্রা পায়। এ বছরের জুনের শেষ দিকে পাকিস্তানে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়। ফলে কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মী জহির রায়হানকে নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা করতে হয়। সৈয়দ শামসুল হক ‘জহির রায়হান’ প্রামান্যচিত্রে স্মৃতিচারণে বলেন, ১৯৫৩-১৯৫৪ সালের দিকে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে জহির রায়হান তখনকার তরুণদের নিয়ে খালি পায়ে রাজপথে হাঁটতেন ও অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতেন। এ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদে।  ১৯৫৫ সালে যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে তিন মাস জেলে কাটান।
১৯৫৫ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ- এ রূপান্তরিত হয়। সেই সঙ্গে দলের অঙ্গ সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ অসাম্প্রদায়িকতার নীতি গ্রহণ করলে জহির রায়হান তাতে যোগ দেন। জানা যায়, ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।  ১৯৫৭ সালে আবারও তিনি গ্রেফতার হয়ে তিন মাস জেলে কাটান। পরবর্তী কয়েক বছর সংস্কৃতি আন্দোলনের সাথেই কাটে তাঁর। ১৯৫৮-৫৯ সালে ঘনিষ্ঠভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি হিসেবে যুক্ত থাকেন।
১৯৬০ এর দশকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে  পালাবদলের আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে। বাংলা বর্ণমালা সংস্কার, বানান পরিবর্তনের চেষ্টা, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার বাংলা সংস্কৃতির ভিতকে সুদৃঢ় করে তোলে। চলচ্চিত্র ও লেখালেখি নিয়ে এ সময়ে জহির রায়হান এ সময়টা রাজনীতিতে তেমন সময় দিতে পারেন নি। তা সত্বেও, এ সময় জহির রায়হান ছাত্র আন্দোলন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, কৃষক র‍্যালিসহ অন্যান্য আন্দোলনকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে গেছেন বলে সাংবাদিক মতিউর রহমান উল্লেখ করেছেন।
১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে  পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুঞ্জিত ক্ষোভ, আন্দোলন ও প্রতিবাদের ক্রমবিকাশ ১৯৬৯ এর শুরুতেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। এ সময় সিনেমা হল বন্ধ থাকে, চিত্রশিল্পের কাজও থাকে প্রায় বন্ধ। ছাত্র ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, লেখক, কবি ও শিল্পীরা প্রতিবাদ জানায়। ৩০ জানুয়ারি চিত্র নির্মাতা ও কুশলীরা এক সভায় মিলিত হয়ে প্রতিবাদ করেন। পরে লিখিতভাবেও তারা প্রতিবাদ জানান। জহির রায়হান এই লিখিত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন।
১৯৬৯ সালের মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কৃষক সমিতির বিক্ষোভ সমাবেশের দৃশ্য তিনি মুভি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন বলে জানান মতিউর রহমান। এ সময়ের আন্দোলন নিয়ে জহির রায়হান নিজেই লিখেন,  ‘জনগণই সবকিছুর উৎস। দেশ তাঁর রাষ্ট্রব্যবস্থা। তাঁর সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, তাঁর রীতিনীতি, সংস্কার, তার ইতিহাস। .... সব শিল্পের উপাদান হচ্ছে জনগণ। উনিশশ’ উনসত্তর সালে সারাদেশ এক দুর্বার গণ আন্দোলনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পিরাও জনতার পাশে এসে দাঁড়ালেন।’
দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছিল ক্রমে ক্রমে। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে জেতার পরও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারছিল না শাসকগোষ্ঠীর টালবাহানায় । উলটো ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। শুরু হয় বাংলার মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল  জহির রায়হান কুমিল্লা দিয়ে ভারতে যান। ১৯৭১ সালের ২৫শে মে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে নব পর্যায়ে চালু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।  জহির রায়হান এ বেতার কেন্দ্রে কথিকা পরিবেশন করতেন।
মে মাসের শেষদিকে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি’ যার সভাপতি হন জহির রায়হান এবং সাধারণ সম্পাদক হন অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম। এ সমিতির প্রধান কাজ ছিল- প্রবাসী বাঙালি শিল্পী ও কলাকুশলীদের থাকা খাওয়াসহ সার্বিক ব্যাবস্থাপনা। ১৯৭১ সালের ৯ জুলাই এ সমিতির উদ্যোগে কলকাতাস্থ মার্কিন দুতাবাসের সামনে বাঙালি নিধনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, মিছিল ও প্রতিবাদের আয়োজন করা হয়। এছাড়া কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়  ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ যার সভাপতি হন ডঃ এ আর মল্লিক এবং সাধারণ সম্পাদক হন জহির রায়হান। এ দুটি সংগঠনের সবচেয়ে অবদান হল, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে সারাবিশ্বে জনমত গড়ার লক্ষ্যে এদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় চারটি শর্ট ফিল্ম। এদের মধ্যে ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এ স্টেট ইজ বর্ণ’ চলচ্চিত্র দুটি নির্মাণ করেন জহির রায়হান। ‘লিবারেশন ফাইটারস’ ও ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’ চলচ্চিত্র দুটি তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত হয়।  ভারতে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্র পরিবেশনায় প্রাপ্ত চার লাখ টাকা সম্পূর্ণ দান করে দিয়েছেণ প্রবাসী সরকারের শরণার্থী তহবিলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিখোঁজ অগ্রজ শহিদুল্লাহ কায়সারকে খোঁজতে গিয়ে পেয়েছেন বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার সন্ধান। ঘোষণাও দিয়েছিলেন, সংবাদ সম্মেলনে তা ফাঁস করবেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে সাংবাদিক জহির রায়হান
কলেজ জীবনের শুরু থেকে জীবনের প্রায় শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জহির রায়হান। তিনি নিষ্ঠার সাথে লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন বাংলা দৈনিক, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র পত্রিকা। কলমের কালিতে তুলে ধরেছেন বাঙালির সুখ, দুঃখ, আশা ও আকাঙ্ক্ষা। বাঙালির বঞ্চনা ও বৈষম্য তাঁকে পীড়া দিত মানসিকভাবে। তার সাংবাদিকতা জীবনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রভাব ও প্রকাশ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট ও উজ্জ্বল।
১৯৫৩ সালে খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস সম্পাদিত ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। কাজ করেছেন মহীউদ্দিন মোহাম্মদ মীর সম্পাদিত ‘স্পন্দন’ পত্রিকায়। ১৯৭০ সালে তাঁর সম্পাদনায় বের হয় চলচ্চিত্রবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘এক্সপ্রেস’ । যাত্রিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় জহির ঢাকার তৎকালীন নাট্য অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন করেন। এর দ্বিতীয় সংখ্যাতে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ছোটগল্প ‘হারানো বলয়’। যে গল্পে দেখা যায়, নারীকে আন্দোলন ও রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সমর্থন করার কারণে শেষে ঐ নারীকে গ্রেফতার করা হয়। সাদা চোখে দেখলে, এ শুধুই একটি গল্প। কিন্তু, ভাবতে হবে এটা কোন সময়ের কথা। বায়ান্নর সেই উত্তাল দিন ও তার পরের উত্তেজনাময় সময় বাঙালির আত্মচেতনাকে ঋদ্ধ ও শুদ্ধ করেছে। তার মূর্ত ও উজ্জ্বল প্রকাশ এই ছোটগল্প।
যুগের দাবি’তে তার প্রথম প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘মুসলীম লীগে মুরগীর লড়াই’। সম্পাদক এ রকম অদ্ভুত শিরোনামের কারণ জানতে চাইলে জহির রায়হান বলেন, ‘আমি ইচ্ছা করেই মুরগীর লড়াই দিয়েছি। কারণ মুসলিম লীগের নেতারা দেখতে চিটাগাঙয়ের মোরগের মত তাগড়া তাগড়া, কিন্তু স্বভাবে তো তারা সব কুঁইচ্চা মুরগী, বাঁঝা মুরগী।‘ ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের একটি কারণ মুসলীম লীগের প্রতি বাঙালির বিরাগভাজনতা। পেশাদারিত্বের বাতাবরণেও জহির রায়হানের সাংবাদিকতায় তার প্রকাশ উচ্চারিত সত্যের সমান।   
শুধু তাই নয়, ১৯৫৬ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘প্রবাহ’র প্রচ্ছদে ছিল কাটা ধানের মোচা হাতে দাঁড়ানো এক কৃষক ও ধান কাটায় ব্যস্ত আরেক কৃষকের ছবি। এ ছবি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যকে প্রকাশ করে শৈল্পিক নৈপুণ্যের সাথে। ব্যবধানের এ চিত্রই বিচ্ছিন্ন করে দেয় অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন। ঘটায় বাঙালির আরাধ্য সোনার-স্বপ্নের দেশের প্রসব। জহির রায়হানের স্বপ্নের সাথে এই ভব্য বাস্তবের প্রাসঙ্গিকতা ও দূরদর্শিতা ছিল লক্ষণীয়। প্রবাহের প্রথম সংখ্যার প্রাসঙ্গিকী বিভাগে তিনি লিখেছেন, ‘মৃতপ্রায় জনজীবনে চাই সাংস্কৃতিক চেতনার দীপ্তি। আলোড়িত কিন্তু পরিস্থিতির সাথে সেই চেতনাকে যুক্ত করিয়াই জাতীয় চেতনার মুক্তি ও সমাধান সম্ভব’ । স্বপ্নের সে মুক্তি এসেছে অরুণের ন্যায় রাঙা হয়ে। কিন্তু তার জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে এক ভয়াল ও বিরূপ সময়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জহির রায়হান সেই সময়ের এক সাহসী সারথি।   
সাহিত্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ
‘ওদের জানিয়ে দাও
ওরা আমাদের ভাই বোনকে কুকুর বিড়ালের মতো মেরেছে
ওদের স্টিম রোলারের নিচে
ওদের জানিয়ে দাও
ওরা যদি দেখেও না দেখে
বুঝেও না বোঝে
আগুনের গরম শলাকা দু’চোখে দিয়ে ওদের জানিয়ে দাও।
মরা মানুষগুলোতে কেমন জীবন এসেছে।‘
১৯৪৯ সালে ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় এই কবিতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক প্রখর সমাজসচেতন, ঐতিহ্য সন্ধানী ও জীবনবোধ সম্পন্ন এক সাহিত্যেকের আগমন। যদিও পরবর্তীতে কবিতা নয়, মনোহর গদ্যে নিপুণ অক্ষরে চিত্রিত করেছেন বাঙালির সমকাল, ভাবনা, লিপ্সা ও আকাঙ্ক্ষা। এর জন্য কখনো হেঁটেছেন খোলা রাস্তায় খালি পায়, চিড়া চিবুচ্ছেন





নৌকার গলুইয়ে বসে
, হাত দিয়েছেন মাঝরাতে খেজুর রসের ভাঁড়ে  শনু পণ্ডিতের পাঠশালা, ধর্মান্ধতার পরাজয় ও নারীর স্বাধীনতায় কখনো দেখছেন সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন। নিজেদের দাবি দাওয়া রক্ষায়, নিজের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় তিনি আবার লিখছেন ‘পোস্টার’, ‘মহামৃত্যু’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি’, ‘কতকগুলো কুকুরের আর্তনাদ’, ‘কয়েকটি সংলাপ ’, ‘সময়ের প্রয়োজনে’ প্রভৃতি ছোট গল্প।
ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।  ভাষা আন্দোলন জহির রায়হানের সাহিত্য জীবনকে প্রভাবিত করেছে বিপুল ভাবে। এ ব্যাপারে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ মনে করেন, ভাষা আন্দোলন জহির রায়হানের সাহিত্যের ভিতকে নির্মাণ করেছে। ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ জহিরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্ম।
এ উপন্যাসের শুরুতে স্মরণ করা হয় সিপাহি বিদ্রোহের স্থান ও পটভূমি। লেখক সিপাহি বিদ্রোহের আটকা পড়া ঝুলন্ত লাশের সাথে একই জায়গায় তৎকালীন বিপ্লবে কারাবন্দী রওশনের তুলনা করে বলেন, সময় পাল্টেছে বটে, মুক্তি মেলে নি। ‘আসছে ফাল্গুনে দ্বিগুন হবো’ বলে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের  ক্রম প্রসারতাকে বোঝায়।
‘সময়ের প্রয়োজনে’ ছোটগল্পে লেখক একাত্ম হয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা নারীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে গিয়ে,
‘ছোট বেশ্যা। মাঝারি বেশ্যা। বড় বেশ্যা। কিশোরী বেশ্যা। যুবতী বেশ্যা। বৃদ্ধা বেশ্যা। ঘৃণায় একপাশে সরে গেল কুলীন যাত্রীরা।...... অনেকগুলো মুখ।......... একটি মুখ আমার মায়ের মতো দেখতে।‘
‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ উপন্যাসে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও ছাত্রসমাজের একজন করে প্রতিনিধি কীভাবে ভাষা আন্দোলনের শিকার  তা বর্ণিত হয়েছে। এদের প্রত্যেকেই দেখেছে ‘মানুষগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অসংখ্য ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছে সামনে
তারপর ওরা দেখল, ‘কতগুলো উদ্ধত মুখ
ঋজু।
কঠিন।
একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলো।
না।
আমরা মানি না। ‘
এভাবে লেখক গল্প বুনেছেন নানান ধাঁচে। কিন্তু তাঁর বেশির ভাগই জীবন থেকে নেয়া। নগরের গল্প, গ্রামের গল্প, ভাষার গল্প, অভাবের গল্প, দ্রোহের গল্প- বেশির ভাগ সামজিক, মাটির সাথে লেপটে থাকা বাঙালির জীবনের গল্প।
চলচ্চিত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদ
বাংলা চলচ্চিত্রে যা কিছু সৃজনশীল, যা কিছু ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংলগ্ন তার পুরোভাগে রয়েছেন রয়েছেন জহির রায়হান ১৯৬১ থেকে ১৯৭১- কখনো আসে নি থেকে এ স্টেট ইজ বর্ণ পর্যন্ত পরিচালক হিসেবে জহির রায়হানের দীপ্ত স্বাক্ষর রয়েছে জহির রায়হানই এদেশে প্রথম আধা পরাবাস্তববাদী (কখনো আসে নি), প্রথম রঙিন (সঙ্গম), প্রথম সিনেমাস্কোপ (বাহানা), প্রথম রূপকধর্মী রাজনৈতিক (জীবন থেকে নেয়া), প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক (স্টপ জেনোসাইড) নির্মাণ করেন  
তার চলচ্চিত্রে যেমন বাঙালির ঐতিহ্য, আকাঙ্ক্ষা, লোকগাথা, সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, তেমনি উচ্চকিত হয়ে উঠেছে বাঙালির ক্ষোভ, অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি ও সে  লক্ষ্যে পরিচালিত মুক্তির সংগ্রাম
বায়ান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ ছিল না শহীদদের স্মরণে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখা হয়েছিল আর ঐ সময় কতিপয় নাট্যকর্মী ও সংস্কৃতিসেবী ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন এদের মধ্যে ছিলেন ডঃ আবদুস সাদেক, আবদুল জব্বার খান, নুরুজ্জামান, সারোয়ার হোসেন প্রমুখ জহির রায়হানকেও তখন দেখা যায় চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষা লাভ বিশেষ করে ক্যামেরাম্যান হওয়ার জন্য কলকাতার প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফিতে ভর্তি হতে
চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের আগমনও প্রতিকূল পরিবেশে। এ জে কারদারের পরিচালনায় সহযোগী হিসেবে ১৯৫৭ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ নামে জহির রায়হান যে ছবিটি  নির্মাণ করেন সেখানে থাকে না  লেখক ও উপন্যাসের নাম। কারণ ধর্মীয় পরিচয়ে লেখক একজন হিন্দু। চিত্রনাট্যকার হিসেবে উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের নাম ব্যবহার করা হয়।  
তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্রকখনো আসে নিতে সৌন্দর্যের সৃজনকারী শিল্পী কীভাবে বেকারত্ব ও অরথনইতিক দুরবস্থার শিকার হয়ে সংসারজীবন ও প্রেমে ব্যর্থ হয়- তাই বিধৃত হয়েছে  অনুপম হায়াৎ এ ছবির মূল্যায়নে বলেছেন, ‘আমরা যদি চলচ্চিত্রে বর্ণিত ধনাঢ্য সুলতানকে একনায়কতন্ত্রের প্রতীক, রক্ষিতা ও বন্দিনী মেরীকে যৌবন, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যের প্রতীক, শওকতকে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত, প্রেমে ব্যর্থ, জীবন ও প্রতিষ্ঠায় পরাজিত তারুণ্যের প্রতীক, দুই বোনের আত্মহত্যাকে স্বপ্নের মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে ধরি- তাহলে ছবির কাহিনির অস্পষ্টতা আর থাকে না’। অর্থাৎ বাঙালির তৎকালীন সমাজব্যাবস্থা, অর্থনীতি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে স্বপ্নের রুপায়ন ঘটাতে পারছিল না, তারই প্রতীকী প্রকাশ ছিল এই ছবি।
বাঙালির আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্কট, বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার টানাপোড়েনে মানবিক ও আত্মিক সম্পর্কের পরিণতির সচিত্র প্রতিবেদন জহির রায়হানের ‘কাঁচের দেয়াল’।  জাহিদ হাসান মাহমুদ ‘ষাট দশকের  সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র’ এ ছবির মূল্যায়নে বলেছেন, ‘কাঁচের দেয়াল- এর কাহিনিতে রয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্নভঙ্গ এবং অপরিণামদর্শী ব্যক্তিগত বিদ্রোহীপনার অবসাদ্গ্রস্ততা’।
‘বেহুলা’ ছবির মাধ্যমে আবহমান গ্রামবাংলার হিন্দুকাহিনিতে যেমন ফিরে যান, তেমনি ‘আনোয়ারা’ ছবিতে ফুটিয়ে তোলেন বাঙালি মুসলমানের সামাজিক কাহিনির চিত্ররূপ। নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন রচিত ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত আনোয়ারা ছবি সম্পর্কে চলচ্চিত্র সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরী (আজাচৌ) সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’তে মন্তব্য করেন, ‘আনোয়ারা’ চিত্রনাট্যে কাহিনির চেয়ে পরিবেশ, লোকাচার, সামাজিকতার উপরই জহির রায়হান গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই পুরো ছবিতে ডিটেলের কাজ উপস্থাপিত। ছোট ছোট দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে বিবাহ অনুষ্ঠান ইত্যাদির চিত্রণ অত্যন্ত রমণীয়ভাবে সুসম্পাদিত’। ...... গ্রাম জীবনের খুঁটিনাটি এই বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তিতে আনোয়ারা একটি সমাজতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও পেতে পারে’।
‘শিল্পে যদি জনগণের দুঃখ, হতাশা, বঞ্চনা ও সংগ্রামের কথা ব্যক্ত করা না যায়, তাহলে শিল্পচর্চা করে কী লাভ? কার জন্যে শিল্পচর্চা করব? নিজের জন্যে? কিন্তু আমি তো এদেশের কোটি কোটি মানুষের একজন। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নই। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একান্ত নিজের জন্য শিল্পচর্চা করার কোন অর্থ আমি খুঁজে পাই না’।
-জহির রায়হান
দেশের আপামর জনসাধারণকে তাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অধিকারকে সচেতন করে তুলতে শিল্পী জহির রায়হান ‘পরিপূর্ণ স্বাধীনতা’ পেতে চাইলেন।  ১৯৭০ সালের ১১ এপ্রিল মুক্তি পায় জহির রায়হান পরিচালিত বাঙালির বহু কাঙ্ক্ষিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবি। যদিও তৎকালীন সামরিক সরকার নানাভাবে এর  নির্মাণ ও মুক্তিদানকে বাধা প্রদান করেছিল। জীবন থেকে নেয়া হল একটি পরাধীন দেশের  স্বাধীনতার দিকে ধীরে ধীরে গমনের একটি ঐতিহাসিক দলিল।
এ ছবি তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র ছবি, যাতে সমকালীন গণ আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, রাজনীতি, পুলিশি নির্যাতন, একুশের বিভিন্ন কর্মসূচি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদ, একনায়কতন্ত্র ও সামরিক স্বেচ্ছাচারের প্রতিবাদ একটি পারিবারিক ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে রুপকভাবে তুলে ধরা হয়েছে ইতিহাসেজীবন থেকে নেয়াই একমাত্র ছবি যা দেখার জন্য জনগণ বিক্ষোভ করেছেন, দাবি তুলেছিলেনজীবন থেকে নেয়াদেখতে চাই, দেখতে চাই এ চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরআমার সোনার বাংলাগান ব্যবহৃত হয় যা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়েছিলএকটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলনশিরোনামের প্রচারণায় বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের প্রতি চলচ্চিত্রকারের পক্ষপাতকে স্পষ্ট করে তুলেছে
জহির রায়হান নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক  চলচ্চিত্রলেট দেয়ার বি লাইটযুদ্ধবিরোধী ও গণহত্যা বিরোধী এ চলচ্চিত্রটি আর কত দিন উপন্যাসের মাধ্যমে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ ছবিটির নির্মাণ তিনি শেষ করে যেতে পারেন নি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জহির রায়হান কলকাতায় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি’ এবং ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ এর সাথে যুক্ত হয়ে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলার কাজে ব্যাপৃত হন।  এ সময় তাঁর পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এ স্টেট ইজ বর্ণ’ এবং তাঁর প্রযোজনায় নির্মিত হয় বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’ ও আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটারস’ ।
স্টপ জেনোসাইডে পাকসেনাদের নির্মম হত্যাকাণ্ড ও মহাপ্রস্থানের পথে ধাবমান শরণার্থীদের করুণ চিত্র শৈল্পিক ভাবে চিত্রিত হয়েছে।  হাজার হাজার শরণার্থীর মিছিল- নাম না জানা ধর্ষিতার করুণ চাহনি, উলঙ্গ শিশুর মুত্রত্যাগের দৃশ্য- বাঙালির করুণ রুপকে স্মরণ করে বার বার। আবার গাঁয়ের পথে আর পাখির ডাকের মধ্যে মালকোঁচা মারা বন্দুক হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের গমনের দৃশ্য দিয়ে বাঙালিকে মুক্তির স্বপ্নও দেখান চলচ্চিত্রকার।
‘ এ স্টেট ইজ বর্ণ’ চলচ্চিত্রে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন গনতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে গঠিত স্বাধীন বাংলা সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাক্ষাৎকার পর্যন্ত বর্ষ অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে  সাজানো হয়েছে। এ ছবির শুরু হয়েছে ‘আমার সোনার বাংলা’ গান, আবহমান বাংলার দৃশ্যাবলী এবং শেষ হয়েছে সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলার প্রতীক শিশিরস্নাত ধানের শিষ দিয়ে।
অন্তরঙ্গ অতীত, বিরূপ বর্তমানকে ছাড়িয়ে সমৃদ্ধির স্বপ্নে বাঙালি বিভোর- এ চেতনাকে ধারণ জহিরের রূপালি ফিতা।
শুধু চলচ্চিত্র পরিচালনা নয়, বাংলা চলচ্চচিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজে প্রযোজনা করেছেন, সাংগঠনিকভাবে সহায়তা করেছেন নবীন চলচ্চিত্রকারদের ১৯৬৭ সালে  জহির রায়হানের নেতৃত্বে গঠিত হয়সিনে ওয়ার্কশপ গোষ্ঠীযার উদ্দেশ্য হল স্বল্প ব্যয়ে স্বল্প খরচে ছবি নির্মাণ এ গোষ্ঠীতে চিত্র পরিচালক হিসেবে ছিলেন নুরুল হক বাচ্চু, আমজাদ হোসেন, মোস্তফা মেহমুদ এবং ক্যমেরাম্যান হিসেবে ছিলেন অরুণ রায় ও এম এ নাসের এ গোষ্ঠী পরবর্তীতে বাংলা চলচ্চিত্র বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাঁদের ব্যানারে মুক্তি পায়দুই ভাই’, ‘সংসার’, ‘বেদের মেয়েকুচবরন কন্যাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ছবি
১৯৬৯ সালে ২৩ মার্চ পূর্বাশা ফিল্মস জহির রায়হানের পরিচালনায়অমর একুশেনামের একটি চলচ্চিত্র উদ্বোধন করার কথা ঘোষণা করা হয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নির্মিতব্য ছবি থেকে লব্ধ আয় একুশের শহিদান ও গণ আন্দোলনে নিহতদের  পরিবারদেরকে দান করার কথা প্রচার করে কিন্তু পড়ে আর সে ছবিটি তৈরি হয় নি
শেষকথা  
নেহাল করিমের ভাষায়, ‘জাতীয়তাবাদের ধারণা বেশি করে বদ্ধমূল হয় তখন যখন কোন দেশের জনগণ বুঝতে পারে যে ক্ষমতাসীন সম্প্রদায় বা শ্রেণি তাদের উপর নির্যাতন এবং শোষণ করছে।‘ পূর্ব পাকিস্তান শুরু থেকেই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা বঞ্চনা, শোষণ, নিপীড়ন, হেয় প্রতিপন্নতার শিকার হয়েছে। যে কারণে পূর্ব বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন ক্রমশ বেড়েছে। ’৪৮ এ ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাতের সময় থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় পর্যন্ত বাঙালিকে ক্রমাগত লড়াই করতে হয়েছে শাসকগোষ্ঠীর সাথে। এ সময়টা বাঙালির জন্য অনুকুল ছিল না মোটেও। আর যেহেতু জহির রায়হান মানবিক বোধ সম্পন্ন ও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি ছিলেন, বাঙালির মনন-রুচি-কাঙ্ক্ষা নিজের ভেতরও অনুভব করতেন। সে কারনেই জীবনব্যাপী কর্ম, শিল্প, সাহিত্যে তিনি বাঙালির জীবনের সাথে মিশে একাত্ম হয়ে গেছেন। তাঁর কণ্ঠই হয়ে উঠেছে লক্ষ বাঙালির কণ্ঠস্বর।

তথ্যসূত্র
১। জহির রায়হান রচনাসমগ্র ১ ও ২
২। জহির রায়হান গল্পসমগ্র
৩। জহির রায়হানের চলচ্চিত্রঃ পটভূমি, বিষয় ও বৈশিষ্ট্য – অনুপম হায়াৎ
৪। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস- অনুপম হায়াৎ সম্পাদিত
৫। বাংলাদেশের ইতিহাস (৩য় খণ্ড)- সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত
৬। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ এবং মৌলবাদ- বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
৭। বাঙলাদেশে জাতীয়তাবাদ : উন্মেষ ও বিকাশ- নেহাল করিম এবং অন্যান্য
৮। বাঙালীর জাতীয়তাবাদ- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
৯। জহির রায়হান তথ্যচিত্র


Comments

Popular posts from this blog

হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০ গান

হুমায়ূন আহমেদ। ১৩ নভেম্বর ,  ১৯৪৮  –  ১৯ জুলাই ,  ২০১২ গদ্যকার, নাট্যকার , চলচ্চিত্রকার ইত্যাদি নানাবিধ পরিচয়ের বহুল প্রচার তাঁর গীতিকার পরিচয়কে ধামাচাপা দিয়ে রাখছে। হুমায়ূন আহমেদ সত্যিকার অর্থে সর্বদিকেই এক যাদুকরের নাম।  ১৩ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা জেনে  নেব  তাঁর লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০  গানের লিরিক্স। সাথে থাকছে ইউটিউব লিংক!   ১। যদি মন কাঁদে,  তুমি চলে এসো  এক বরষায় এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে, জল ভরা দৃষ্টিতে যদি কোমল শ্যামল ছায়।। যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী, কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরী উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো ঝলকে ঝলকে নাচিবে বিজলি আলো।।  নামিবে আঁধার বেলা ফুরাবার ক্ষণে মেঘমল্লার বৃষ্টির মনে মনে কদমগুচ্ছ খোঁপায় জড়ায়ে দিয়ে জলভরা মাঠে নাচিবো তোমায় নিয়ে।।  ভিডিও লিংক-  https://youtu.be/VBS1yyHTxek?list=PLS1Hg7Qpin0RgzvTf6xai0ZDZcxAtENB6 ২। চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে কে আইসা দাড়াইসে গো আমার দুয়ারে। তাহারে চিনি না আমি...

কামরুল কাইসের ১০ কবিতা

১. মহামারি  স্থির সময় অথির বেগে দ্যাখায় যেন অসময়ের ফল। ২. মিতালি ওসব কথা থাক- একটু নিবিড় চঞ্চু তোমার নদীর যেন বাঁক। দৃশ্যে মাখো কালি‌ - তীরে বসে দেখছি নদী দিচ্ছি শিস আর তালি। দন্তসমেত হাঙর ছোটে করাল স্রোতে তোর আমি ডাকি শান্ত দোয়েল  তাতেই নষ্ট ভোর! আজকে এসব রাখ- অল্প কথার কথকতা দূর মিলিয়ে যাক। ৩. প্রাপ্তি মেঘের কান্না দেখব বলে আকাশে তাকিয়েছিলাম নেই, নেই কান্না শুধু এ মনেই। ঊষরতা পাবো বলে মরুভূমি চেয়েছিলাম নেই, নেই ফুল ফোটা সবখানেই। কাকে ছোঁব বলে যেন হাত বাড়িয়ে ছিলাম নেই, নেই রয়ে গেছে সে চির ভাবনাতেই। ৪. স্বাধীনতার সনেট ভেসে ছিল দেশ যবে শোণিত ধারায়, আর্তের ক্রন্দনে ছিল স্পর্শ বেদনার। পাখির সুরেলা কণ্ঠ বন্ধ ছিল হায়! হৃদয়-রক্ত ক্ষরণে বাংলা নিঃসাড়, রবির কিরণ নেই ঊষা-নীলিমায়, আকাশে ভাসল ধোঁয়া বারুদ বোমার পান্থ শ্রান্তি সারল না অশ্বত্থ ছায়ায়- অপরাহ্ণে নেমে এল নিকষ আঁধার! মাঠের সবুজতায় রক্তিম পরশ স্বাধীন প্রাণ স্পন্দন এলো অবশেষে- কণ্ঠে জাগাল সংগীত সপ্তসুর এসে! চেতনার রন্ধ্রে পূর্ণ গভীর হরষ উচ্ছসি হল উদ্ভাস। আজো বহমান। স্বাধীন-তটিনী-ধারা, হবে না প্রয়াণ। ৫. অপহৃত আকাশ যদি না কখনো গোধূ...