উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মুসলমান সমাজ কিছুটা সচেতন এবং নিজেদের অবস্থার উন্নয়নে সচেষ্ট হয়ে উঠে। ইংরেজ সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়নের ফলেই মুসলমানরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকেছে। ফলে তাদের মধ্যে এমন সব কুসংস্কার এসে বাসা বেঁধেছে যা তৎকালীন নারী সমাজের সর্বাধিক দুঃখের ও কষ্টের কারন হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে মুসলমান সমাজ কিছুটা সচেতন এবং নিজেদের অবস্থার উন্নয়নে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। সমাজ পরিবর্তনের এ দায়িত্ব যারা হতে তুলে নিয়েছিলেন ফয়জুন্নেসা তাদেরই একজন। শিক্ষা, দীক্ষায়, কর্মে ও সম্পদে বাঙালি জাতি উন্নত হবে। প্রতিষ্ঠিত করে নিবে বিশ্বের বুকে আপন মর্যাদার আসন, এটাই ছিল তাঁর আজীবন সাধনা। উনবিংশ শতকের চতুর্থ দশকে পূর্ব বাংলার এক নির্ভৃত পল্লীতে জন্মগ্রহন করে যে নারী অমর অবদান রেখে গেছেন তা চিরদিন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব। তিনি অনেকটা নিজের অদম্য ইচ্ছার কারনে শিক্ষিত হন। শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা ইতিহাসে বিরল ।
জন্ম
নওয়াব ফয়জুন্নেসার জন্ম কুমিল্লা জেলার হোমনাবাদ পরগনার (বর্তমানে লাকসামের) অন্তর্গত পশ্চিমগাঁয়ে । তিনি ১৮৩৪ সালে জন্মগ্রহন করেন । তাঁর বাবার নাম আহমেদ আলী চৌধুরী , বাবা জমিদার আর মা-আরাফান্নেসা চৌধুরাণী ।
ব্যক্তিগত ও কর্মজীবন
প্রথম জীবন
তিনি তাঁর বাবার প্রথম কন্যাসন্তান। সে সময় জমিদার বংশের সন্তান হিসেবে বেশ আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। মোগল রাজত্বের উত্তরসূরী এই মহীয়সী নারীর দুই ভাই( এয়াকুব আলী চৌধুরী এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী) আর দু’বোন (লতিফুন্নেসা চৌধুরাণী এবং আমিরুন্নেসা চৌধুরাণী) ছিল । ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় তাঁর প্রচুর আগ্রহ দেখে তার বাবা তার জন্য একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালন করে তাঁর জ্ঞানস্পৃহাকে আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তোলেন। গৃহশিক্ষকের সাহায্যে ফয়জুন্নেসা খুব দ্রুতই কয়েকটি ভাষার উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন । বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত এ চারটি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ সহ ফয়জুন্নেসার এ প্রতিভা স্ফুরণে তাঁর শিক্ষক তাজউদ্দিনের অবদান অতুলনীয়।
বিয়ে
সে সময়ের আরেক স্বনামধন্য জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজীর সাথে ১৮৬০ সালে তার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন মোহাম্মদ গাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তার দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের হয়নি। । এক পর্যায়ে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে । স্বামী বিচ্ছেদের পর তিনি সমাজ সংস্কার ও গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
কথিত আছে নওয়াব ফয়জুন্নেসা ১৮৫১ সালে বিয়ের সতের বছর পর জানতে পারেন তার স্বামীর আরেকটি স্ত্রী আছে । তাই সতীন থেকে পৃথক থাকার জন্য তিনি তার বিয়ের কাবিনের এক লক্ষ এক টাকা দিয়ে পশ্চিমগাও এ সাড়ে তিন একর জমিতে একটা বাড়ি করেন । এটি নির্মাণ করতে তিন বছরের মত সময় লেগেছিল।
জমিদারি লাভ
তিনি জমিদারি পরিচালনার প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন । তাছাড়া বুদ্ধির দীপ্ততা, বিচক্ষণতা আর কর্মদক্ষতায় তিনি অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন । তাই ১৮৭৩ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারি লাভ করেন এবং ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি মাতুল সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হন।
জমিদারি পরিচালনা
ফয়জুন্নেসা তার চিন্তা কাজ কর্মে ছিলেন সে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। সেকালের সমাজ ব্যবস্থার সবরকম বাঁধা পেরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনযোগ দিয়েছিলেন । তাই একজন নারী হয়েও সে সময়ে জমিদারির কঠোর দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করতে পেরেছেন । তিনি নির্ভীকভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করেন।
তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে ওয়ারিশদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেন আর নিজ জমিদারিটি পরিণত করেন 'ওয়াকফ' সম্পত্তি হিসেবে।
![]() |
এই বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী |
কুমিল্লার তদানীন্তন জেলা প্রশাসক মি. ডগলাস ওই জেলার জন্য জনহিতকর সংস্কারমূলক একটা পরিকল্পনা হাতে নিয়ে অর্থাভাবে বড় বিপদে পড়েন। তৎকালীন অর্থশালী বিত্তবান হিন্দু জমিদারদের কাছে তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ ঋণ হিসেবে চেয়েছিলেন। কিন্তু অর্থের পরিমাণ শুনে সবাই তাদের অপারগতা জানান। মি. ডগলাস কিন্তু কোনো মুসলমান জমিদারের কাছে এ আবদার জানাননি। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মুসলমানদের কাছ থেকে তিনি কোনো সাহায্যই পাবেন না। কারণ ইংরেজদের প্রতি তারা ছিলেন বিরূপ মনভাবাপন্ন। তাছাড়া পশ্চিমগাঁওয়ের জমিদার ছিলেন একজন নারী। এলাকার সংস্কার প্রকল্পে যখন কোনো হিন্দু পুরুষ জমিদার সাহায্যের হাত বাড়ালেন না, তখন একান্ত নিরুপায় হয়ে মি. ডগলাস জমিদার ফয়জুন্নেসার সাহায্য কামনা করেন। দূরদর্শী জমিদার ফয়জুন্নেসা মি. ডগলাসের সংস্কারমূলক পরিকল্পনার খুঁটিনাটি সবিশেষে মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং জনকল্যাণ কতটুকু হবে তা ভেবে দেখার জন্য সময় নেন। এরপর তিনি প্রকল্পটি ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখেন। একপর্যায়ে জনকল্যাণের কথা ভেবে প্রয়োজনীয় অর্থের সম্পূর্ণটাই একটা তোড়ায় বেঁধে একখানি চিঠিসহ মি. ডগলাসের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি চিঠিতে মি. ডগলাসকে লিখেছিলেন- 'আমি জনকল্যাণমূলক যেসব কাজ করতে চেয়েছিলাম তা আপনার হাত দিয়েই হোক, এই আশা করি। ... ফয়জুন্নেসা যে টাকা দেয় তা দান হিসেবেই দেয় কর্জ হিসেবে নয়।'
সুদূর বাংলাদেশের নিভৃত পল্লীর একজন নারী জমিদারের সমাজসেবা ও উদার হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীও অত্যন্ত অভিভূত হয়েছিলেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া তার সভাসদের পরামর্শক্রমে মি. ডগলাসকে নির্দেশ দেন জমিদার ফয়জুন্নেসাকে মহারানীর আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে সরকারিভাবে 'বেগম' উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হোক। ডগলাস সাহেব ফয়জুন্নেসাকে এ ঘটনা জানালে তিনি সরাসরি মহারানীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান 'জমিদার হিসেবে নিজে জমিদারিতে 'বেগম' হিসেবে তিনি এমনিতেই সবার কাছে পরিচিত। সুতরাং নতুন করে 'বেগম' খেতাবের কোনো প্রয়োজন নেই।' তেজস্বী এই মহীয়সী জমিদারের কাছে ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হলে মি. ডগলাস বড়ই বিপাকে পড়েন। ডগলাস নিরুপায় হয়ে তিনি সম্পূর্ণ ঘটনাটি পুনরায় মহারানীকে জানান। মহারানীর প্রস্তাব প্রত্যাখানের কথা শুনে রানী ফয়জুন্নেসার তেজস্বীতায় একাধারে অভিভূত এবং অন্যধারে গভীর সমস্যায় পড়েন। তারপর তাঁকে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে 'নওয়াব' খেতাব দেওয়া হয়।
লাইফ স্টাইল
ব্যক্তিগত জীবনে ফয়জুন্নেসা রুটিনমাফিক দৈনন্দিন জীবন যাপন করেছেন। যারা বড় হয়, তাদের একটা স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য থাকে। সময়ানুবর্তিতা ও নিয়ম নিষ্ঠা ছিল তার জীবনের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। শীত-গ্রীষ্মকাল নির্বিশেষে এবাদত বন্দেগী ও কর্মরীতি ছিল নি¤œরূপ। প্রতিদিন শেষরাতে উঠে অজু করে যথারীতি জায়নামাজে বসতেন। প্রথমে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। নামাযান্তে কুরআন তেলাওয়াত করতেন ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত। ফজরের নামাজ শেষ করে তিনি আবার বসতেন কুরআন তেলাওয়াতে।
বেলা আটটা নাগাদ কুরআন তেলাওয়াত শেষ করে সামান্য নাস্তা গ্রহন করতেন। এরপর বসতেন জমিদারীর দপ্তরে। জমিদারী কাজ শেষ হওয়ার পরে সামান্য বিশ্রামের পর গোসলের সময় অন্দরের দেয়ালবেষ্টিত পুকুরে নিয়মিত সাঁতার কাটতেন। খানাপিনা শেষ করে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতেন। জোহরের নামায শেষে আবার বসতেন জমিদারীর কাজ নিয়ে। আসরের নামায শেষে বসতেন ফয়জুন্নেসা পুস্তকালয়ে। বাকি সময়টা কাটাতেন এবাদত, পারিবারিক কাজ এবং অধ্যয়ন করে।
জমিদার ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণীর অবদান
সমাজ সংস্কার
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব। তিনি সমাজ সংস্কারের অংশ হিসেবে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি জোর প্রচেষ্টা করেন । ১৮৭৩ সালে ('বেগম রোকেয়া'র জন্মের সাত বছর পূর্বেই) নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি মেয়েদের জন্য কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয়প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশের বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীন স্কুলগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
শিক্ষা প্রচার
দেশে বিদেশে শিক্ষার প্রচারে তার অবদান অনস্বীকার্য। নওয়াব ফয়জুন্নেসা (পশ্চিমগাঁয়ে) একটি অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার ছাত্রদের অন্য একটি ছাত্রাবাসও ছিল।মাদ্রাসার ভালো ফলাফলে উৎসাহিত হয়ে পরবর্তিকালে তাঁর (ফয়জুন্নেসার) বংশধরগণ ১৯৪৩ খ্রীঃ এটিকে উচ্চ মাধ্যমিক ইসলামিক কলেজে রূপান্তরিত করেন। ১৯৬৫ খ্রীঃ কলেজটি একটি ডিগ্রী কলেজে রূপান্তরিত হয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেসা ডিগ্রী কলেজ নামে আখ্যায়িত হয়। ১৯৮২ খ্রীঃ এ কলেজটির সরকারিকরণ হয় এবং নাম হয় "নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ" । তাছাড়া তিনি আর তার কন্যা বদরুন্নেসা পশ্চিমগাঁওয়ে "নওয়াব ফয়জুন্নেসা ও বদরুন্নেসা উচ্চবিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেন। মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য তিনি সব সময় উৎসাহিত করতেন। তিনি মেয়েদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার জমিদারির আয় থেকে মেয়েদের জন্য নির্মিত এ হোস্টেলের সব খরচ বহন করা হতো। মেয়েদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন । তিনি পবিত্র মক্কা শরিফে 'মাদ্রাসা-ই-সওলাতিয়া ও ফোরকানিয়া সহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে প্রচুর পরিমানে সহায়তা করেন।
বিবিধ
শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন । ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন 'ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল'। ১৮৯৩ সালে নওয়াব বাড়ির কাছেই তিনি মেয়েদের জন্য একটি স্বতন্ত্র হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন । তিনি ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনেকগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এতিমখানা এবং সড়ক নিমার্ণ করে তার মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি নওয়াব বাড়ীর সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করার সময় তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি 'মুসাফিরখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের এদেশে তখন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিদ্যমান ছিল । নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারী জনহিতকর কাজেও প্রচুর অর্থ দান করতেন ।
সাহিত্য চর্চা
রবীন্দ্রযুগে যে কয়জন বাংলা সাহিত্য সাধনা করে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন, নবাব ফয়জুন্নেসা তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে নবাব ফয়জুন্নেসা এর নাম চিরস্মরণীয়।
তার সাহিত্য সাধনার খুব অল্প সময়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক লেখক। শুধু তাই নয় প্রথম মুসলিম গদ্য-পদ্যে লেখিকা ছিলেন। ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দে ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা গিরিশচন্দ্র মুদ্রণ যন্ত্র থেকে শ্রীমতি নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী রচিত সাহিত্য গ্রন্থ ‘রূপজালাল' প্রকাশিত হয়। তাঁর চারখানি পুস্তক-পুস্তিকার সন্ধান পাওয়া যায়- ‘রূপ জালাল (১৮৭৬ খ্রি.)’ তত্ত্ব ও জাতীয় সঙ্গীত (১৮৮৭ খ্রি.), ‘সঙ্গীত সার’ ও ‘সঙ্গীত লহরী’। তাঁর তত্ত্ব ও জাতীয় সঙ্গীত একটি সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্থ। এর প্রথম সংস্করণ ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ও মুদ্রক হরিমোহন বসাক, ঢাকা, বাঙ্গালা প্রেস। তাঁর ‘রূপ জালাল’ ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থের কপি পাওয়া যায়নি।
‘রূপ জালাল’ গদ্যে-পদ্যে রচিত রূপকধর্মী রচনা। গ্রন্থখানি ব্যতিক্রমধর্মী। সংস্কৃত গদ্য-পদ্য মিশ্রিত চম্পু কাব্যের নিদর্শন থাকলেও বাংলাতে তা বিরল। মধ্যযুগে বৈষ্ণব ভাবধারায় দু-একখানি চম্পুকাব্য রচিত হলেও উনিশ শতকে এ ধরনের দ্বিতীয় গ্রন্থ রচিত হয়নি। দ্বিতীয়ত ফয়জুন্নেসার গদ্য-পদ্য উভয় অংশ বিশুদ্ধ বাংলায় রচিত। আরবি-ফারসি শব্দের মিশ্রণ নেই বললেই চলে। ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী গল্পের নায়ক জালাল ও নায়িকা রূপবানুর প্রণয়কাহিনীর মধ্যে কৌশলে স্বীয় জীবনের ছায়াপাত ঘটিয়েছেন। ব্যতিক্রম একটি ক্ষেত্রে যে, নিজের দাম্পত্যজীবন ব্যর্থতা ও বেদনায় পূর্ণ। রূপ জালালের প্রেম ও দাম্পত্যজীবন সুখ ও আনন্দে পরিপূর্ণ। সৃষ্টির এখানেই স্বার্থকতা। ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতাকে সৃষ্টিকর্মে তিনি সফল হতে দেখেছেন। তিনি অন্তর্দাহ প্রকাশ করতে গিয়ে ‘রূপ জালাল’ উপন্যাস রচনায় মাঝে মাঝে কবিতার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ‘রূপ জালাল’ এ ফুটে উঠেছে ফয়জুন্নেসার কবি প্রতিভা।
সতীন বিদ্বেষের কারণেই ফয়জুন্নেসার বিবাহিত জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়। রূপ বানুর সতীন হুরবানু তাদের পরিণতি কিরূপ ছিল? গ্রন্থের শেষ কয়েকটি চরণে তা’ প্রকাশ পেয়েছে-
হুর বানু নিয়ে রানী, রূপবানু মনে।
মিলন করিয়া দিল প্রবোদ বচনে ॥
দোহে সম রূপবতী সম বুদ্ধিমতী।
বিভূ কৃত ভেবে দোহে জন্মিল সম্প্রীতি ॥
উভয় সপত্নী নানা গুণে গুণবতী।
আনন্দে বিহরে দোহে পতির সঙ্গতি ॥
দুইজন নিয়ে সম দৃষ্টিতে রাজন।
নিত্য সকৌতুকে কাল করয়ে যাপন ॥
সিংহাসনে বসি সদা হরিষে অন্তরে।
বিধি বিধানেতে ভূপ রাজকার্য্য করে ॥
বিচার কৌশলে দূর হৈল অবিচার।
প্রজার জন্মিল ভক্তি সুখ্যাতি প্রচার ॥
সতীন বিদ্বেষের কারণেই ফয়জুন্নেসার বিবাহিত জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়। রূপ বানুর সতীন হুরবানু তাদের পরিণতি কিরূপ ছিল? গ্রন্থের শেষ কয়েকটি চরণে তা’ প্রকাশ পেয়েছে-
হুর বানু নিয়ে রানী, রূপবানু মনে।
মিলন করিয়া দিল প্রবোদ বচনে ॥
দোহে সম রূপবতী সম বুদ্ধিমতী।
বিভূ কৃত ভেবে দোহে জন্মিল সম্প্রীতি ॥
উভয় সপত্নী নানা গুণে গুণবতী।
আনন্দে বিহরে দোহে পতির সঙ্গতি ॥
দুইজন নিয়ে সম দৃষ্টিতে রাজন।
নিত্য সকৌতুকে কাল করয়ে যাপন ॥
সিংহাসনে বসি সদা হরিষে অন্তরে।
বিধি বিধানেতে ভূপ রাজকার্য্য করে ॥
বিচার কৌশলে দূর হৈল অবিচার।
প্রজার জন্মিল ভক্তি সুখ্যাতি প্রচার ॥
রাজা ন্যায়বিচারক ও প্রজানুরঞ্জন হবেন- এটাও তার কাম্য ছিল। স্বামী বিচ্ছেদের প্রায় ৯ বছর পরে ‘রূপ জালাল’ প্রকাশিত হয়। তিনি গ্রন্থখানি স্বামীর নামেই উৎসর্গ করেন। বাস্তবে দুঃখ যন্ত্রণার পঙ্কে থেকে তিনি কল্পনায় প্রেমানন্দের পদ্মফুল ফুটিয়েছেন।
‘জাতীয় ভাষা অপরিহার্য্য’ ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। এরূপ সাহসী উচ্চারণের জন্য তিনি আমাদের সবার শ্রদ্ধার পাত্রী। এই ভাষার পথ ধরেই আমরা জাতীয়তা, স্বাধীকার ও স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়েছি।
ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী গানও লিখেছেন। ‘রূপ জালাল’ কাব্যে গান আছে। বার মাসি, সহেলা, বিরহ বিলাপ, খেদোক্তি ইত্যাদি শিরোনামে যে সব পদ্য আছে সে গুলোও সঙ্গীত’। সঙ্গীত সম্পর্কিত তাঁর স্বতন্ত্র গ্রন্থও আছে। এসব দৃষ্টান্ত থেকে প্রমাণিত হয়, ফয়জুন্নেসা সঙ্গীতানুরাগিনী ছিলেন। সঙ্গীতের সমর্থক ছিলেন তিনি। বনেদি মুসলিম পরিবারের একজন মহিলার জন্য এটিও একটি সাহসী পদক্ষেপ। ‘রূপজালাল' ব্যতীত ফয়জুন্নেসা কর্তৃক দু'খানি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়-‘সঙ্গীত লহরী' ও ‘সঙ্গীত সার' প্রকাশিত হলেও তা এখন দুষ্প্রাপ্য। সামগ্রীকভাবে বিবেচনা করলে তার স্থান বাংলা কাব্য বিশেষত মধুসূধন, বিহারীলাল ও সুরেন্দ্রনাথের পাশাপাশি। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না সাহিত্য সাধনায় ফয়জুন্নেসার পথ ধরে বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব হয়েছে । বাংলার নারীদের সাহিত্যে অবদানে নওয়াব ফয়জুন্নেসা সর্বাগ্রে।
‘জাতীয় ভাষা অপরিহার্য্য’ ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। এরূপ সাহসী উচ্চারণের জন্য তিনি আমাদের সবার শ্রদ্ধার পাত্রী। এই ভাষার পথ ধরেই আমরা জাতীয়তা, স্বাধীকার ও স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়েছি।
ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী গানও লিখেছেন। ‘রূপ জালাল’ কাব্যে গান আছে। বার মাসি, সহেলা, বিরহ বিলাপ, খেদোক্তি ইত্যাদি শিরোনামে যে সব পদ্য আছে সে গুলোও সঙ্গীত’। সঙ্গীত সম্পর্কিত তাঁর স্বতন্ত্র গ্রন্থও আছে। এসব দৃষ্টান্ত থেকে প্রমাণিত হয়, ফয়জুন্নেসা সঙ্গীতানুরাগিনী ছিলেন। সঙ্গীতের সমর্থক ছিলেন তিনি। বনেদি মুসলিম পরিবারের একজন মহিলার জন্য এটিও একটি সাহসী পদক্ষেপ। ‘রূপজালাল' ব্যতীত ফয়জুন্নেসা কর্তৃক দু'খানি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়-‘সঙ্গীত লহরী' ও ‘সঙ্গীত সার' প্রকাশিত হলেও তা এখন দুষ্প্রাপ্য। সামগ্রীকভাবে বিবেচনা করলে তার স্থান বাংলা কাব্য বিশেষত মধুসূধন, বিহারীলাল ও সুরেন্দ্রনাথের পাশাপাশি। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না সাহিত্য সাধনায় ফয়জুন্নেসার পথ ধরে বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব হয়েছে । বাংলার নারীদের সাহিত্যে অবদানে নওয়াব ফয়জুন্নেসা সর্বাগ্রে।
স্বীকৃতি
ভারতের নিভৃত পল্লীর এ বিদূষী রমণী বেঁচে থাকতে তার কাজের স্বীকৃতি সেভাবে পাননি । মহারাণী ভিক্টোরিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ফয়জুন্নেসাকে বেগম এবং এর পর নওয়াব উপাধি দেন । ১৮৮৯ সালে তার নির্দেশক্রমে ফয়জুন্নেসাকে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে 'নওয়াব' উপাধি দেয়া হয়।
২০০৪ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।
![]() |
মহীয়সী এই নারীর নামে স্মারক ডাকটিকেট |
মৃত্যু
১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এ মহীয়সীর জীবনাবসান ঘটে। তাকে তার প্রতিষ্ঠিত দশগুম্বুজ মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়
Comments
Post a Comment