মেঘনা, গোমতী ও
ডাকাতিয়া নদী বিধৌত কুমিল্লা বাংলাদেশের এক সুপ্রাচীন নগর জনপদ। শত মনীষীর
পদধূলিতে ধন্য এ মাটির বক্ষ জুড়ে রয়েছে অপরিমেয় সম্পদ ও সম্ভাবনা। এই অঞ্চল এক
সময় প্রাচীন সমতটের অধীনে এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। নবম শতাব্দীতে
এ জেলা হরিকেলের রাজাদের অধীনে আসে। এ শহরের ৫ কিমি পশ্চিম-দক্ষিণে লালমাই
ময়নামতিতে দেব বংশ (অষ্টম শতাব্দী) ও চন্দ্র বংশের (দশম ও একাদশ শতাব্দীর
মাঝামাঝি) রাজত্ব ছিল। এ জেলা ১৭৬৫ সালে প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে
আসে। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলা নামে এই জেলা গঠিত হয়। ১৯৬০ সালে কুমিল্লা জেলা
নামকরণ হয়। ১৯৮৪ সালে এই জেলার চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমা জেলায় উন্নীত
হয়।
কর্মময় ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ড. আখতার হামিদ খান ছিলেন একাধারে কবি, শিক্ষাবিদ,
সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পত্রিকার সম্পাদক, সমাজবিজ্ঞানী, উন্নয়নকর্মী এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এ দেশের মেহনতি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। সমবায় মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন অসংখ্য কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে। হতদরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়নের ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সমবায়কে নতুন রূপ দিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন এমন একটি মডেল, যাতে সদস্যরা গণতান্ত্রিকভাবে ‘একজন এক ভোটে’র ভিত্তিতে আইনগতভাবে সংগঠিত হতে পারে। সঞ্চয়কে পুঁজিতে পরিণত করে নিজেদের প্রয়োজনেই বিনিয়োগ করতে পারে। সৃষ্টি করতে পারে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, যার মাধ্যমে সমাজে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে।
এ মহান ব্যক্তি ১৯১৪ সালের ১৫ জুলাই ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরিলীর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৩৪ সালে আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। আইসিএস অফিসার হিসেবে কর্মজীবনের বেশি সময়ই তিনি পূর্ববাংলায় চাকরি করেন। ১৯৩৪ সালে তদানীন্তন বৃটিশ ভারতের সর্বোচ্চ সম্মানজনক ‘আইসিএস’ চাকুরী লাভ করেন। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের সাহায্যের বিষয়ে বৃটিশ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে নীতিগত ভাবে মত পার্থক্যের কারণে লোভনীয় আইসিএস চাকরি হতে তিনি ইস্তফা প্রদান করেন। অতঃপর ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন কেটেছে বড় বিচিত্রভাবে । তিনি কখনো তালামিস্ত্রী, কখনো কাঠ মিস্ত্রী, কখনো পত্রিকার সম্পাদক, কখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক পদে চাকরি করেন। ১৯৫০ সালে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন। অধ্যক্ষ হয়েই তিনি সম্পৃক্ত হলেন দেশের মাটি ও মানুষের সাথে। এ দেশের গরিব কৃষক, তাদের সন্তানদের শিক্ষা, জীবনের দুঃখজনক অকাল সমাপ্তি, দুর্ভিক্ষ, ফসলহানি ইত্যাদি সমস্যাগুলো তিনি প্রত্যক্ষ করেন এ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। এই কলেজে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। এখানেই গ্রামের উন্নয়ন সম্পর্কে তার গভীর আগ্রহ এবং তৃণমূলপর্যায়ে উন্নয়ন সম্পর্কিত বৈপ্লবিক ধারণার বিকাশ ঘটে। তিনি কৃষকসহ শ্রমজীবীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে।
১৯৫৮
সালে পল্লী উন্নয়নে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে
গমন করেন। ফিরে এসে ১৯৫৯ সালে তিনি কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) প্রতিষ্ঠা
করেন। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ের এ মডেলটি তাকে
কিংবদন্তিতে পরিণত করে এবং এনে দেয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি। বার্ড
শুধু কোন একাডেমি নয়। এটি আখতার হামিদ খানের স্বপ্নমন্দ্রিত বৈপ্লবিক প্রেরণার
একটি অনন্য শৈলীসজ্জা। অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন, উৎপাদন, সমতা,
ঐক্য, শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সবুজাভ
শ্যামলিমা, জীবনবোধ, মানবতাবোধ
প্রভৃতিসহ মানব জীবনের প্রত্যেকটি প্রত্যয়ের পরিচ্ছন্ন বিকাশে আইসিএস অফিসার আখতার
হামিদ খানের বার্ড একটি মনোলোভা বিন্যাসের প্রমুগ্ধ ইতিহাস। বার্ড ধারণা আখতার
হামিদ খানকে সারা বিশ্বে উৎপাদনশৈলীর অনিবার্য কিংবদন্তিতে পরিণত করে। একই সাথে
বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিও উজ্জ্বল হয়।
‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’ এ সত্যটি তিনিই সর্বপ্রথম উপলদ্ধি করেছিলেন। এ সত্যটি মাথায় রেখে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করলেন ‘কুমিল্লা পদ্ধতি’। ছয়টি উপাদান দিয়ে তিনি এই পদ্ধতি গঠন করেনঃ
(১)
থানা ট্রেনিং এবং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (টিটিডিসি) যা বর্তমানে উপজেলা কমপ্লেক্স
(২) রুরাল ওয়ার্ক্স প্রোগ্রাম যা বর্তমানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)
(৩)
থানা ইরিগেশেন প্রোগ্রাম (টিআইপি) যা বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের সাথে সম্পৃক্ত (বিএডিসি)
(৪)
থানা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ এসোসিয়েশন, যা বর্তমানে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (৫) ইমাম প্রশিক্ষণ যা বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং
(৬) পরিবার পরিকল্পনা যা বর্তমানে পরিকল্পনা অধিদপ্তর নামে পরিচিত।
কুমিল্লা পদ্ধতি এদেশের গরিব জনসংখ্যার ভাগ্য উন্নয়নে একটি বাস্তব ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে কুমিল্লা পদ্ধতি মানব কল্যাণে অবস্থান রাখতে শুরু করে। যার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৩ সালে ফিলিপাইন সরকার তাঁকে “ম্যাগসেসে” পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রিতে ভূষিত করে। এভাবে তিনি বিশ্বনন্দিত, বিশ্বখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী সংস্কারক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ড.
খান এর সুনাম আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে।
এতগুণের অধিকারী হয়েও তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। ছিলেন একজন সুপুরুষ। দৈহিক অবয়বে লম্বায় সাত ফুট। গায়ের রঙ ফর্সা। চেহারায় সৌন্দর্যের লাবণ্য। তিনি সারা কুমিল্লায় হেঁটেই চলাফেরা করতেন। শালপ্রাংশু দেহের মানুষটি দেবদারু বৃক্ষের মতো সোজা হয়ে
পথ চলতেন। পরনে থাকত অজানুলম্বিত
খাকি রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি ও একই কাপড় ও রঙের পাজামা। জরুরি হলে সাইকেল ব্যবহার করতেন। তিনি সারা দিন অফিস করে রাতে বা যখন সময় পেতেন তখনই গ্রামে চলে যেতেন সাধারণ মানুষের কাছে। গ্রামে গিয়ে তিনি মানুষের সাথে মাটিতে বসে খেতেন। গ্রামে গেলে বা কোন সভায় তাঁকে চেয়ারে বসতে কেউ কখনও দেখেনি। তিনি গ্রামে গিয়ে বলতেন, ‘আমি কিছু বলতে আসি নি, আমি এসেছি আপনাদের নিকট থেকে কিছু শিখতে’।
জীবনের কোন পর্যায়ে তিনি অন্যের বশ্যতা মেনে নেননি, নিতেও পারেননি। কোনদিন অর্থলোভে প্রলুব্ধ হননি। তাঁর প্রশাসন ছিল চোখে পড়ার মত। তাঁকে কখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে দেখা যায়নি। যে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত যেন তাঁর মনেই গেঁথে থাকতো। প্রশাসক হিসাবে তাঁর দু’ একটি ঘটনা নিম্নরূপঃ পাকিস্তান আমলে কোন এক সময়ে জেলা প্রশাসকগণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য এই একাডেমিতে আসেন। প্রশিক্ষণ সময়ে একজন অভিযোগ করলেন যে, কক্ষ থেকে তাঁর কলম চুরি হয়ে গেছে। ড. খান সাহেব এ অভিযোগ শোনার পর মন্তব্য করলেন আমার একাডেমির লোক চোর নয়। আপনি ভাল করে খুঁজে দেখুন। পরবর্তীতে কলম খুঁজে পাওয়া গেল অভিযোগকারীর বিছানার নিচে। তখন তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর কলম হাতে দিয়ে বলেন আপনাকে একাডেমিতে আরো দু’ সপ্তাহ থাকতে হবে। আপনার কক্ষ আপনাকে প্রতিদিন পরিস্কার করতে হবে। কারণ হিসেবে তাকে বললেন- আপনি জেলার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আপনি নিজেই ভুল করে অন্যকে চোর বানালেন, এটা আপনার শাস্তি।
অপর একটি ঘটনা। একাডেমি ক্যাফেটেরিয়াতে সেলফ সার্ভিস (নিজের খাওয়া নিজে নেয়া) ব্যবস্থা তখনকার প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা বিধায় একাডেমিতে আগত বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণার্থী ও পরিদর্শকগণ তা সহজভাবে গ্রহণ করতে চাইতো না। কিন্তু ড. খান সাহেব এ ব্যাপারে কাঠোর ও আপোষহীন মনোভাব গ্রহণ করেন। ড. খান নিজে কখনো সেলফ সার্ভিস পদ্ধতি ভঙ্গ করেননি বরং উচ্চ পদমর্যাদার যে কোন কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের খাবার নিজেই টেবিলে বহন করে নিয়ে যেতেন। ক্যাফেটেরিয়াতে একটা মন্তব্য রেজিষ্ট্রার ছিল। এতে অনেকে সেলফ সার্ভিস সর্ম্পকে মন্তব্য করতেন। ড. খান মাঝে মধ্যে রেজিষ্ট্রারের মন্তব্য দেখে তাঁর নিজের জবাব বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন এবং তা সংশ্লিষ্টদের নিকট পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।
ড. খান পটুয়াখালীর মহকুমা হাকিম। তাঁর কোর্টে এক মা তার ছেলের বিরুদ্ধে একটি মামলা দাখিল করেন। মায়ের অভিযোগ, ছেলে তার খোঁজ খবর রাখে না। তার খাওয়া দাওয়ার প্রতিও উদাসীন। ছেলে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, মা অশ্রুসজল, খান সাহেব সব শুনে রায় দিলেন “ছেলের পেটে দশটা ইট বেঁধে তাকে কোর্টের বারান্দায় দশবার আসা যাওয়া করতে হবে”। রায়মত ছেলেটার পেটে ইট বাঁধা হলো ঠিকই কিন্তু ছেলেটা ক’বার বারান্দার হেঁটে হাপিয়ে যায়। আর হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। খান সাহেব তাকে বললেন, তোমার মা এমনিভাবে তোমাকে দশ মাস পেটে ধারণ করে সংসারের ঝামেলা সহ্য করে চলাফেরা করেছিল। তুমি সে মাকে ভরণ-পোষণ দিতে অবজ্ঞা করছো, তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে। ছেলের এরূপ অবস্থা দেখে মা কেঁদে ফেলেন এবং খান সাহেবের নিকট হাতজোড় করে ছেলেকে মাফ করার জন্য প্রার্থনা করেন। ছেলে মাকে কোনদিনও অবজ্ঞা করবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করায় মুচলেকার মাধ্যমে ছেলেকে মাফ করে দেয়া হয়। তাঁর বিচার ছিল বাস্তবমুখী।
মন মানসিকতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন মানব দরদী ও সমাজ হিতৈষী। দেশে তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। না খেয়ে ও অসুস্থতায় লোকজন রাস্তা ঘাটে মরে যাচ্ছে। এমনি সময়ে একদিন ড. খান উঁচু বর্ণের হিন্দু আরদালীকে সাথে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখেন খালের পাড়ে একটি লোক অসুস্থতায় কাতরাচ্ছে। অসুস্থ লোকটিকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার জন্য খান সাহেব আরদালীকে হুকুম দিলেন। কিন্তু আরদালী কিছুতেই অসুস্থ লোকটিকে ধরতে রাজী হলেন না। কারণ অসুস্থ লোকটি জাতে মেথর বা নিচু বর্ণের । ফলে তাকে স্পর্শ করলে ওর জাত যাবে। তখন খান সাহেব অসুস্থ লোকটিকে কাঁধে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেন।
বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ছাত্র/শিক্ষক সমন্বয়ে গঠিত রিলিফ কমিটির কার্যকলাপ পরিচালনার দায়িত্বও নিজ কাঁধে তুলে নিতেন। একবার তিনি কিছু গুঁড়ো দুধ, আটার বস্তা আর বিস্কুট নিয়ে গাড়িতে করে রিলিফ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বন্যার পানিতে রাস্তা ডুবে যাওয়ায় গাড়ি থেকে তিনি পানিতে নেমে এক বস্তা আটা তাঁর কাঁধে উঠিয়ে স্কুলের রিলিফ ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন।
ড. খান এর অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, অকুতোভয়তা, প্রবল সাহসিকতা ও স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি ছিল তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য। একদিনের এক ঘটনা। ড. খান ক্লাস নিচ্ছিলেন। এমন সময় কলেজের একজন কর্মচারী এসে ড. খানকে বললেন, “স্যার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোঃ আইয়ুব খান আপনার কাছে টেলিফোন করেছেন”। ড. খান একটু থেমে বললেন- বলে দিন এখন তিনি ক্লাস নিচ্ছেন। এক ঘন্টা পরে তিনি যেন টেলিফোন করেন। ড. খানের এরূপ কথা শুনে ছাত্ররা সবাই অবাক হয়ে গেল। এটা সম্ভব ছিল এক মাত্র ড. খানের মত বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারীর পক্ষেই।
অপর একটি ঘটনা। একাডেমিতে একদিনের একটি প্রাদেশিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক সকল কর্মকর্তা এ সম্মেলনে যোগদান করেন। সকাল ১০ টায় অডিটরিয়ামে গভর্নরের সম্মেলন উদ্বোধন করার কথা। ড. খান গভর্নরকে রিসিভ করার জন্য সকাল ১০টার কিছু পূর্বে বিমান বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন। কিন্তু সময়মত তিনি না আসায় ড. খান বিমান বন্দর হতে একাডেমিতে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে বেলা ১১ টার সময় গভর্নর একাডেমিতে এসে পৌঁছালে ড. খান তাঁকে একাডেমীর কারপোর্চে (গাড়ি বারান্দা) রিসিভ করেন।
ড. খান এর মত সৎ লোক এ দুনিয়াতে ক’জন আছে তা জানা নেই। তাঁর মত সততা ও মহানুভবতার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বগুড়ায় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা জন্য ড.আখতার হামিদ খানকে নিয়োগ দেয়া হয় এবং এ কাজের জন্য তাঁকে এক লক্ষ টাকা বেতন দেয়া হবে। তিনি বলেন, আমি কুমিল্লাতে কাজ করেছি মাসিক ২৩০০/- টাকা বেতনে। আমি কুমিল্লা থেকেই বগুড়ার কাজ করবো এবং এ কাজের জন্য তিনি মাসিক এক লক্ষ টাকার পরিবর্তে ২৩০০/- টাকা দাবি করেন। কিন্তু সরকার ও প্রশাসনের সাথে মতানৈক্যের কারণে কিছু দিন পর তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান।
একবার গরমের সময় পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে প্রশাসনিক ভবন ও অন্যান্য দালান কোঠার কাজ চলছিল তাঁরই তত্ত্বাবধানে। জনৈক ঠিকাদার কাজের তদারকির জন্য ড. খানকে নিতে এলেন রাণীর দিঘির পূর্ব কোণে তাঁর বাসা থেকে। ঠিকাদার কিছুক্ষণ ড্রইং রুমে অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় ঠিকাদার শুনতে পেলেন তাঁর সহধর্মিনীর কথা । তাঁর স্ত্রী বলছিলেন বাসায় গরমে থাকা যাচ্ছে না। তিনটি কক্ষের জন্য তিনটি বৈদ্যুতিক পাখার প্রয়োজন। ড. খান উত্তরে বলেছিলেন, ‘এখন আমার হাতে টাকা নেই। বেতন পেয়ে নিয়ে আসব। ঠিকাদার তাঁদের কথোপকথন শুনে পরদিন তিন কক্ষের জন্য তিনটি পাখা এনে ফিট করে দিয়ে আসেন। বাসায় এসে বিষয়টি ড. খান জানতে পেরে কাউকেই কিছু বললেন না। এক মাস পর উক্ত ঠিকাদারকে ডেকে পাঠালেন এবং পাখাগুলো ফেরৎ দিয়ে পাখাগুলোর ভাড়া বাবদ ৩০০/- টাকা দিয়ে দিলেন এবং তার এ উপকারের জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
ড. আখতার হামিদ খান ছিলেন পল্লী উন্নয়নের অপরাজেয় শিল্পী, শিল্পী তুলি দিয়ে ছবি আঁকেন। ভাস্কর শিল্পী শিল্প তৈরী করেন হতুড়ি বাটাল দিয়ে। ড. খান ছিলেন অন্য এক জগতের শিল্পী। পল্লী উন্নয়নের শিল্পী। গ্রামের মাটি ও মানুষকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক অপরূপ শিল্প, যার নাম পল্লী উন্নয়ন। পল্লী উন্নয়নের তিনি পথিকৃৎ। তাঁর এ কৃত কর্মের জন্য তিনি চির অমর হয়ে থাকবেন কুমিল্লাবাসী তথা উপমহাদেশ ও সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষের হৃদয়ে।
জীবনের কোন পর্যায়ে তিনি অন্যের বশ্যতা মেনে নেননি, নিতেও পারেননি। কোনদিন অর্থলোভে প্রলুব্ধ হননি। তাঁর প্রশাসন ছিল চোখে পড়ার মত। তাঁকে কখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে দেখা যায়নি। যে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত যেন তাঁর মনেই গেঁথে থাকতো। প্রশাসক হিসাবে তাঁর দু’ একটি ঘটনা নিম্নরূপঃ পাকিস্তান আমলে কোন এক সময়ে জেলা প্রশাসকগণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য এই একাডেমিতে আসেন। প্রশিক্ষণ সময়ে একজন অভিযোগ করলেন যে, কক্ষ থেকে তাঁর কলম চুরি হয়ে গেছে। ড. খান সাহেব এ অভিযোগ শোনার পর মন্তব্য করলেন আমার একাডেমির লোক চোর নয়। আপনি ভাল করে খুঁজে দেখুন। পরবর্তীতে কলম খুঁজে পাওয়া গেল অভিযোগকারীর বিছানার নিচে। তখন তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর কলম হাতে দিয়ে বলেন আপনাকে একাডেমিতে আরো দু’ সপ্তাহ থাকতে হবে। আপনার কক্ষ আপনাকে প্রতিদিন পরিস্কার করতে হবে। কারণ হিসেবে তাকে বললেন- আপনি জেলার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আপনি নিজেই ভুল করে অন্যকে চোর বানালেন, এটা আপনার শাস্তি।
অপর একটি ঘটনা। একাডেমি ক্যাফেটেরিয়াতে সেলফ সার্ভিস (নিজের খাওয়া নিজে নেয়া) ব্যবস্থা তখনকার প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা বিধায় একাডেমিতে আগত বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণার্থী ও পরিদর্শকগণ তা সহজভাবে গ্রহণ করতে চাইতো না। কিন্তু ড. খান সাহেব এ ব্যাপারে কাঠোর ও আপোষহীন মনোভাব গ্রহণ করেন। ড. খান নিজে কখনো সেলফ সার্ভিস পদ্ধতি ভঙ্গ করেননি বরং উচ্চ পদমর্যাদার যে কোন কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের খাবার নিজেই টেবিলে বহন করে নিয়ে যেতেন। ক্যাফেটেরিয়াতে একটা মন্তব্য রেজিষ্ট্রার ছিল। এতে অনেকে সেলফ সার্ভিস সর্ম্পকে মন্তব্য করতেন। ড. খান মাঝে মধ্যে রেজিষ্ট্রারের মন্তব্য দেখে তাঁর নিজের জবাব বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন এবং তা সংশ্লিষ্টদের নিকট পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।
ড. খান পটুয়াখালীর মহকুমা হাকিম। তাঁর কোর্টে এক মা তার ছেলের বিরুদ্ধে একটি মামলা দাখিল করেন। মায়ের অভিযোগ, ছেলে তার খোঁজ খবর রাখে না। তার খাওয়া দাওয়ার প্রতিও উদাসীন। ছেলে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে, মা অশ্রুসজল, খান সাহেব সব শুনে রায় দিলেন “ছেলের পেটে দশটা ইট বেঁধে তাকে কোর্টের বারান্দায় দশবার আসা যাওয়া করতে হবে”। রায়মত ছেলেটার পেটে ইট বাঁধা হলো ঠিকই কিন্তু ছেলেটা ক’বার বারান্দার হেঁটে হাপিয়ে যায়। আর হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। খান সাহেব তাকে বললেন, তোমার মা এমনিভাবে তোমাকে দশ মাস পেটে ধারণ করে সংসারের ঝামেলা সহ্য করে চলাফেরা করেছিল। তুমি সে মাকে ভরণ-পোষণ দিতে অবজ্ঞা করছো, তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে। ছেলের এরূপ অবস্থা দেখে মা কেঁদে ফেলেন এবং খান সাহেবের নিকট হাতজোড় করে ছেলেকে মাফ করার জন্য প্রার্থনা করেন। ছেলে মাকে কোনদিনও অবজ্ঞা করবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করায় মুচলেকার মাধ্যমে ছেলেকে মাফ করে দেয়া হয়। তাঁর বিচার ছিল বাস্তবমুখী।
মন মানসিকতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন মানব দরদী ও সমাজ হিতৈষী। দেশে তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। না খেয়ে ও অসুস্থতায় লোকজন রাস্তা ঘাটে মরে যাচ্ছে। এমনি সময়ে একদিন ড. খান উঁচু বর্ণের হিন্দু আরদালীকে সাথে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখেন খালের পাড়ে একটি লোক অসুস্থতায় কাতরাচ্ছে। অসুস্থ লোকটিকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার জন্য খান সাহেব আরদালীকে হুকুম দিলেন। কিন্তু আরদালী কিছুতেই অসুস্থ লোকটিকে ধরতে রাজী হলেন না। কারণ অসুস্থ লোকটি জাতে মেথর বা নিচু বর্ণের । ফলে তাকে স্পর্শ করলে ওর জাত যাবে। তখন খান সাহেব অসুস্থ লোকটিকে কাঁধে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেন।
বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ছাত্র/শিক্ষক সমন্বয়ে গঠিত রিলিফ কমিটির কার্যকলাপ পরিচালনার দায়িত্বও নিজ কাঁধে তুলে নিতেন। একবার তিনি কিছু গুঁড়ো দুধ, আটার বস্তা আর বিস্কুট নিয়ে গাড়িতে করে রিলিফ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বন্যার পানিতে রাস্তা ডুবে যাওয়ায় গাড়ি থেকে তিনি পানিতে নেমে এক বস্তা আটা তাঁর কাঁধে উঠিয়ে স্কুলের রিলিফ ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন।
ড. খান এর অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, অকুতোভয়তা, প্রবল সাহসিকতা ও স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি ছিল তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য। একদিনের এক ঘটনা। ড. খান ক্লাস নিচ্ছিলেন। এমন সময় কলেজের একজন কর্মচারী এসে ড. খানকে বললেন, “স্যার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোঃ আইয়ুব খান আপনার কাছে টেলিফোন করেছেন”। ড. খান একটু থেমে বললেন- বলে দিন এখন তিনি ক্লাস নিচ্ছেন। এক ঘন্টা পরে তিনি যেন টেলিফোন করেন। ড. খানের এরূপ কথা শুনে ছাত্ররা সবাই অবাক হয়ে গেল। এটা সম্ভব ছিল এক মাত্র ড. খানের মত বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারীর পক্ষেই।
অপর একটি ঘটনা। একাডেমিতে একদিনের একটি প্রাদেশিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক সকল কর্মকর্তা এ সম্মেলনে যোগদান করেন। সকাল ১০ টায় অডিটরিয়ামে গভর্নরের সম্মেলন উদ্বোধন করার কথা। ড. খান গভর্নরকে রিসিভ করার জন্য সকাল ১০টার কিছু পূর্বে বিমান বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন। কিন্তু সময়মত তিনি না আসায় ড. খান বিমান বন্দর হতে একাডেমিতে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে বেলা ১১ টার সময় গভর্নর একাডেমিতে এসে পৌঁছালে ড. খান তাঁকে একাডেমীর কারপোর্চে (গাড়ি বারান্দা) রিসিভ করেন।
ড. খান এর মত সৎ লোক এ দুনিয়াতে ক’জন আছে তা জানা নেই। তাঁর মত সততা ও মহানুভবতার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বগুড়ায় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা জন্য ড.আখতার হামিদ খানকে নিয়োগ দেয়া হয় এবং এ কাজের জন্য তাঁকে এক লক্ষ টাকা বেতন দেয়া হবে। তিনি বলেন, আমি কুমিল্লাতে কাজ করেছি মাসিক ২৩০০/- টাকা বেতনে। আমি কুমিল্লা থেকেই বগুড়ার কাজ করবো এবং এ কাজের জন্য তিনি মাসিক এক লক্ষ টাকার পরিবর্তে ২৩০০/- টাকা দাবি করেন। কিন্তু সরকার ও প্রশাসনের সাথে মতানৈক্যের কারণে কিছু দিন পর তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান।
একবার গরমের সময় পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে প্রশাসনিক ভবন ও অন্যান্য দালান কোঠার কাজ চলছিল তাঁরই তত্ত্বাবধানে। জনৈক ঠিকাদার কাজের তদারকির জন্য ড. খানকে নিতে এলেন রাণীর দিঘির পূর্ব কোণে তাঁর বাসা থেকে। ঠিকাদার কিছুক্ষণ ড্রইং রুমে অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় ঠিকাদার শুনতে পেলেন তাঁর সহধর্মিনীর কথা । তাঁর স্ত্রী বলছিলেন বাসায় গরমে থাকা যাচ্ছে না। তিনটি কক্ষের জন্য তিনটি বৈদ্যুতিক পাখার প্রয়োজন। ড. খান উত্তরে বলেছিলেন, ‘এখন আমার হাতে টাকা নেই। বেতন পেয়ে নিয়ে আসব। ঠিকাদার তাঁদের কথোপকথন শুনে পরদিন তিন কক্ষের জন্য তিনটি পাখা এনে ফিট করে দিয়ে আসেন। বাসায় এসে বিষয়টি ড. খান জানতে পেরে কাউকেই কিছু বললেন না। এক মাস পর উক্ত ঠিকাদারকে ডেকে পাঠালেন এবং পাখাগুলো ফেরৎ দিয়ে পাখাগুলোর ভাড়া বাবদ ৩০০/- টাকা দিয়ে দিলেন এবং তার এ উপকারের জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
ড. আখতার হামিদ খান ছিলেন পল্লী উন্নয়নের অপরাজেয় শিল্পী, শিল্পী তুলি দিয়ে ছবি আঁকেন। ভাস্কর শিল্পী শিল্প তৈরী করেন হতুড়ি বাটাল দিয়ে। ড. খান ছিলেন অন্য এক জগতের শিল্পী। পল্লী উন্নয়নের শিল্পী। গ্রামের মাটি ও মানুষকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক অপরূপ শিল্প, যার নাম পল্লী উন্নয়ন। পল্লী উন্নয়নের তিনি পথিকৃৎ। তাঁর এ কৃত কর্মের জন্য তিনি চির অমর হয়ে থাকবেন কুমিল্লাবাসী তথা উপমহাদেশ ও সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষের হৃদয়ে।
অপর এক ঘটনায় ড. খানের মধ্যে মানবিক আচরণের প্রমাণ পাওয়া যায়। একদিন অসহায় সম্বলহীন এক ভয়ংকর বসন্তরোগী অসহ্য যন্ত্রণায় রাস্তার পাশে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আকস্মিকভাবে ড.
খান তখন ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ঘটনা তাঁর চোখে পড়ামাত্র তিনি গাড়ি থেকে নেমে এসে নিজে কোলে করে ঐ বসন্ত রোগীকে গাড়িতে বসিয়ে স্থানীয় সদর হাসপাতালে পৌঁছে দিলেন। বসন্ত রোগী সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তিনি হাসপাতালে ধর্ণা দিয়েছিলেন।
আখতার হামিদ খান শুধু আইসিএস অফিসার কিংবা বার্ড মডেলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। একাধারে তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী, হৃদয়াকর্ষক প্রাবন্ধিক, যৌক্তিক বিশ্লেষক এবং দুরদর্শী প্রতিবেদক। তিনি শুধু প্রবন্ধ রচনা করেন নি,
কবিতা ও ভ্রমণ কাহিনীও রচনা করেছেন। তার প্রবন্ধগুলো গল্প-কবিতার চেয়েও অনেক আকর্ষিক ছিল। বাগ্মী হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। সহজে মানুষকে আকৃষ্ট করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার মজ্জাগত।
ইংরেজি, বাংলা, আরবি, ফার্সি, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় তিনি দক্ষ ছিলেন। বিভিন্ন ভাষায় তার অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। পল্লী উন্নয়ন, সমাজ সচেতনতা, সাধারণ মানুষের মানসিক চেতনার সাথে সম্মিলিত প্রয়াস ও উৎপাদনের সম্পর্ক তার প্রবন্ধের মূল উপজীব্য। আখতার হামিদ খানের অধিকাংশ লেখা পল্লী উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও বিষয়বস্তু, পরিবেশনার ধরন,
বিশ্লেষণ, যুক্তি, ভাষার গাঁথুনি প্রভৃতি বিবেচনায় অনেকগুলো লেখা সাহিত্যমান উত্তীর্ণ হৃদয়গ্রাহী প্রবন্ধের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
রুর্যাল ডেভলাপমেন্ট ইন ইস্ট পাকিস্তান (১৯৬৫), মিশিগান ইউনিভার্সিটি, লাহোর, করাচি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ পৃথিবীর আরও কয়েকটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি এবং প্রকাশনা সংস্থা হতে তার প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও প্রতিবেদন নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। তার অনেকগুলো প্রবন্ধ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ ক্লাশে পড়ানো হয়। তিনি একটি ভ্রমণ কাহিনীও রচনা করেছেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনীটির নাম ‘টুয়েন্টি উইকস ইন আমেরিকা’। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত আমেরিকা অবস্থানকালীন দিনলিপির উপর ভিত্তি করে গ্রন্থটি রচিত। উর্দুতেও তিনি একটি ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন। এর নাম
‘সফর-ই- আমেরিকা-কি ডায়েরি’ (১৯৭২)। শুধু প্রবন্ধ কিংবা ভ্রমণ কাহিনী নয়,
তিনি কবিতাও লিখেছেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে উর্দুভাষায় ‘চিরাগ আওর কানওয়াল’ শিরোনামে আখতার হামিদ খানের একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়।
বার্ড কর্তৃপক্ষ আখতার হামিদ খানের লেখাগুলোকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্যা ওয়ার্কস অব আখতার হামিদ খান’ শিরোনামে প্রকাশিত করে। পল্লী উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা ও কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ‘সিতারা-ই-পাকিস্তান’ পদকে ভূষিত হন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট তিনি র্যামন ম্যাগসেসেই পুরষ্কার লাভ করেন। একই বছর মিশিগান ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করেন। এ ছাড়া তিনি মরণোত্তর ‘নিশান-ই-
ইমতিয়াজ’ (২০০৪) এবং
‘জিন্নাহ এওয়ার্ড’ (২০০১)
লাভ করেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের ইন্ডিয়ানা পলিশে আখতার হামিদ খান মৃত্যুবরণ করেন।
ড. আখতার হামিদ খান ছিলেন পল্লী উন্নয়নের অপরাজেয় শিল্পী, শিল্পী তুলি দিয়ে ছবি আঁকেন। ভাস্কর শিল্পী শিল্প তৈরী করেন হাতুড়ি বাটাল দিয়ে। ড.
খান ছিলেন অন্য এক জগতের শিল্পী। পল্লী উন্নয়নের শিল্পী। গ্রামের মাটি ও মানুষকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক অপরূপ শিল্প, যার নাম পল্লী উন্নয়ন। পল্লী উন্নয়নের তিনি পথিকৃৎ। তাঁর এ কৃত কর্মের জন্য তিনি চির অমর হয়ে থাকবেন কুমিল্লাবাসী তথা উপমহাদেশ ও সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষের হৃদয়ে।
Comments
Post a Comment