শারফিন শাহ।
প্রতিভাবান তরুণ লেখকদের একজন। লিখছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। সম্প্রতি
যুক্ত হয়েছেন একটি গবেষণা পত্রিকার সাথে। তবে তাঁর মূল কৃতিত্বের জায়গা হল-
ঋতুভিত্তিক সংকলন ও সাহিত্য কাগজ ‘পল্লব’ সম্পাদনা- সমকালীন নবীন ও অপ্রতিষ্ঠিত
লেখকদের মলাটবন্দী করার কাজটি সুচারুভাবে যা করে আসছে বেশ ক বছর ধরে। তাঁর লেখায়
সমকাল বীক্ষা, ঐতিহ্যমগ্নতা, আধুনিকতা ও সাবলীলতার সামষ্টিক প্রকাশ দৃশ্যমান।
শারফিন শাহের সাথে
এক আড্ডায় এক সন্ধ্যা কাটিয়ে এলেন চোখ-এর নির্বাহী সম্পাদক কামরুল কাইস। এ আড্ডা ও
ভাব বিনিময়ের চুম্বক অংশ চোখের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হল।
কামরুল কাইসঃ শুভ
সন্ধ্যা, শারফিন ভাই। কেমন আছেন? কী পড়ছিলেন?
শারফিন শাহঃ শুভ সন্ধ্যা, কামরুল। খুবই ভালো ও আনন্দে আছি।
আনন্দে থাকতে পছন্দ করি। কেননা আনন্দে থাকাটাই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় দিক, বড়
পাওয়া। এ মুহূর্তে পড়ছিলাম কবি শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকারসমগ্র নিয়ে ‘কবিকথন’
বইটি, যাতে শামসুর রাহমান তাঁর লেখক ও ব্যক্তিগত জীবনের অনালেখ্য দিক বলেছেন
নিপুনভাবে। এছাড়া, পড়ার টেবিলে সামনে কয়েকদিন যে বইগুলো থাকবে বলে মনস্থির করেছি
সেগুলো হল- সানজু’র আর্ট অব ওয়ার ও সৈয়দ শামসুল হকের সর্বশেষ বই ‘জন্মান্ধ রমজান’।
কামরুল কাইসঃ অনেক
দিন ধরে সাহিত্যের কাগজ ‘পল্লব’ সম্পাদনা করছেন। প্রায় একক প্রচেষ্টায় এ কাগজ
সম্পাদনা করতে গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা ও শুরুর গল্প শুনতে পারি?
শারফিন শাহঃ অবশ্যই। যখন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন আমার ইচ্ছে ছিল একটি শিল্পিত বিশ্ববিদ্যালয় জীবন
আমি কাটাব। কিন্তু, দেখা গেল এখানে শিল্পচর্চার পরিবেশটা কেমন দলছুট ও স্তিমিত হয়ে
পড়েছে। আমরা জানি, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে
একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ
ব্যক্তিত্ব নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনও করছে।
![]() |
পল্লবের গ্রীষ্মকালীন সংখ্যা |
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর
থেকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ মুক্ত চিন্তা ও সাহিত্যের বিকাশে বিরুদ্ধ
ভূমিকা রেখে চলেছে। তার ছিটেফোঁটা পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ পরিস্থিতির
উত্তরণ ও বর্তমানের দায়বদ্ধতা আমার মধ্যে তৈরি করেছে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
স্যারের বই পাঠ। সরাসরি কথা হল স্যারের সঙ্গে।
![]() |
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ |
স্যার বলছিলেন, ‘সাহিত্য বিষয়ে কাজ
করতে গেলে কারও কথা শোনা যাবে না। সাহিত্য সমাজের নেতা হতে হলে আগে নিজেকে বুঝতে
হবে। নিজের কথা মানতে হবে। ষাটের দশকে আমি যে কষ্ট স্বীকার করে ‘কণ্ঠস্বর’
সম্পাদনা করেছি, সে কষ্ট যদি আনন্দের সাথে গ্রহণ করতে পারো, তাহলে তুমি এগোতে
পারো।’ বলা চলে, স্যারের পরামর্শ ও প্রেরণাতেই আমি পল্লব সম্পাদনা শুরু করি।
![]() |
পল্লবের শীত সংখ্যা |
কামরুল কাইসঃ আপনার
শৈশব ও কৈশোর বর্তমান লেখালেখিতে কেমন
প্রভাব রাখছে?
শারফিন শাহঃ আমার শৈশবটা ছিল বর্ণিল ও আনন্দময়। আমি গ্রামে
বড় হয়েছি। চারপাশে বিস্তৃত গাছপালা। আমাদের বাড়ির পাশে ছোট একটা নদী ছিল। সে নদীটি
এখন শুকিয়ে গেছে। মনে পড়ে, সে নদীতে আমি মাছ ধরতাম। বাবা বিভিন্ন সময়ে আমাকে
বাজারে নিয়ে যেতেন। বাজারে মিষ্টি খাওয়া হতো খুব। দোকানি ময়রা সব সময় কেন জানি
আমাকে একটি মিষ্টি বেশি দিতেন। তারপর, প্রথম সাহিত্য পাঠের প্রেরণা ষষ্ঠ শ্রেণিতে
পড়া অবস্থায় আমার প্রাইভেট শিক্ষক সজল বাবুর কাছ থেকে। আমি স্কুল জীবনে বাড়িতে বই পড়েছি। কলেজ জীবনে পড়েছি লাইব্রেরির প্রায় সব বই। শ্রীকান্ত দিয়ে যে পাঠের
যাত্রা শুরু হল, তা আজও চলছে সমান মুগ্ধতায়। এই যে আমি এখন সাহিত্যের জগতে
প্রবেশের সাহস পাচ্ছি, আমার শৈশব ও সজল বাবু সেখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে
আছে।
কামরুল কাইসঃ আপনার
লেখায় সমকালীন সমাজচেতনতা ও ঐতিহ্যবোধের যুগপৎ প্রকাশ ঘটেছে। চতুর্দিক নিরীক্ষার এ
আঙ্গিক মানব মননে কতটা প্রভাব রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
শারফিন শাহঃ আসলে একজন লেখক যখন লিখেন, তাঁর মাথায় সমাজ
পরিবর্তন কিংবা পাঠকের আনন্দের চিন্তা থাকে না, যদিও লেখালেখি সমাজকে ঘিরেই। তিনি
নিজের মনের আনন্দে লিখেন। পাখি যখন গান গায় কিংবা ফুল যখন সৌরভ ছড়ায় তখন পাখি বা
ফুল অন্যের আনন্দ নিয়ে ভাবে না। নিজের আনন্দই মুখ্য। আর কারও লেখায় সমাজ পরিবর্তন
সহায়তা করে কি না, তা নির্ভর করে পাঠকের উপর। বাস্তবতার কাদামাটি ও কল্পনার তুলি এ
দুয়ের সমন্বয়ে পাঠককে নাড়া দিতে পারলে মনন এবং তার ফলে সমাজে ও জগতে পরিবর্তন
আসবে।
![]() |
'পল্লব' এর লেখক চিঠি |
কামরুল কাইসঃ আপনার
লেখালেখির পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিবেশ অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কতটা অনুকূল?
শারফিন শাহঃ লেখালেখির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনকার যে
পরিবেশ তা অনুকূল অবশ্যই না, বরং প্রতিকুল বলা চলে। এখনকার হল, মাঠ ও লাইব্রেরি
কিছুই আগের মত আর নেই। বদলানোটা স্বাভাবিক । কিন্তু এ পরিবর্তন যাতনাদায়ী। সবুজ
ঘাসে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে লাল ইট। ঘাসে বসে আড্ডা দেয়ার মত জায়গা কমে যাচ্ছে।
সাহিত্যের জন্য প্রকৃতি পাঠ গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যা বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে।
তদুপরি, রাজনীতি, নৈতিকতা ও সংস্কৃতির অবক্ষয় চারপাশকে ঘিরে ফেলেছে। তবু আমাদের
আশার প্রদীপ অন্ধকারেও টিমটিম জ্বলতে থাকবে।
কামরুল কাইসঃ একবিংশ
শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য এক অনির্ণেয় রূপে ঘূর্ণায়মান বলে কথা হচ্ছে। এ থেকে
উত্তরণে আমাদের কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
শারফিন শাহঃ সময়ের সাথে পরিবর্তন সব কিছুতে ঘটছে। সাহিত্যের
প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে বর্তমানে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে
উঠেছে। অনেক প্রতিষ্ঠিত ও নবীন লেখকগণ নিয়মিত লিখছেন। তবে, একবিংশ শতাব্দীতে
আধুনিকতাবাদ সাহিত্যে ততটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে না। সাম্প্রদায়িকতা সাহিত্যকে এখন
আঁকড়ে ধরে রেখেছে। আর হ্যাঁ, তত্বভিত্তিক লেখাগুলো সাধারণ পাঠকের নিকট বোধগম্য ও
সাবলীল প্রকাশভঙ্গীতে উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা
তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন’। এখন সাধারণ পাঠক কি বলতে পারবে এখানে
উত্তরাধুনিকতার প্রকাশ ঘটেছে? কিংবা জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পরাবাস্তববাদের প্রকাশ
কোথায় ঘটেছে? কিন্তু ঠিকই তারা কবিতা সহজে বুঝে নিচ্ছেন, আনন্দ পাচ্ছেন। কাজেই এখানে
মতামত হল, আমাদের বর্তমান সাহিত্য হবে সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষার কিন্তু বিশ্বমান
সম্পন্ন।
![]() |
শারফিন শাহের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ময়মনসিংহে |
কামরুল কাইসঃ সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যম মারফত জানতে পারলাম, ‘‘সোনার পাথর বাটি” নামে আপনার একটি বই
প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এই বই নিয়ে কিছু শুনতে চাই।
শারফিন শাহঃ ‘সোনার পাথর বাটি’ মুলত একটি উপন্যাসিকা। একটি
মিষ্টি প্রেমের গল্প। আমি অনেক পরিশ্রম করেছি বইটি লিখতে গিয়ে। আগামি বইমেলা বা
তার আগে বইটি প্রকাশিত হতে পারে। আমি আশা করছি, বইটি পাঠকের ভালো লাগবে।
কামরুল কাইসঃ তরুণ
যারা এখন লিখছেন, তাদের নিয়ে আপনার মূল্যায়ন ও প্রত্যাশা কী?
শারফিন শাহঃ তরুণ লেখক বলতে আমি বোঝাচ্ছি, বয়স যাদের এখনও
ত্রিশ পেরোয় নি। আমার চারপাশে নতুন অনেক লেখক লিখছেন। তারা সবাই একসময় নামকরা কিংবা
প্রতিষ্ঠিত লেখক হবেন, এমনও নয়। তবু, কিছু তরুণ আছেন যাদের মধ্যে আমি দারুণ
সম্ভাবনার আলো দেখি। তার মধ্যে প্রথমেই বলব সাফি উল্লাহ্র কথা। অসাধারণ গল্প লেখে
সে। ভালো কিছু জায়গা থেকে সে গল্প লিখছে।
নতুন চিন্তাধারা হলেও তার গল্পগুলো
কিন্তু দুর্বোধ্য নয়- পাঠকের কাছে পৌঁছায়। মনের মধ্যে শিল্পের রস সঞ্ছার করে।
কবিতার ক্ষেত্রে আমি বলব, তুমি- কামরুল কাইস খুব ভালো লিখছ। তোমার কবিতা পল্লবে
ছাপা হয়েছে, আমি পড়েছি। তারপর, সুজন শান্তনু খুব ভালো কবি। তার কবিতায় ছন্দ আছে।
ছড়ার জন্য যে ছেলেটা বেশি পরিশ্রম করে, শাহাদাৎ শাহেদ, খুব ভালো ছড়া লিখে। আর
শিশুসাহিত্য নিয়ে ভালো কাজ করছেন সাইফুল ইসলাম জুয়েল। এছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে
আরও অনেক তরুণ লেখালেখি করছেন- চর্চা ও বিকাশের মাধ্যমে তারাও হয়ে উঠতে পারেন
সাহিত্যের এক একটি নক্ষত্র।
![]() |
সাইফুল ইসলাম জুয়েল |
![]() |
সুজন শান্তনু |
একটি ব্যাপার হল,
এখনকার লেখকদের মধ্যে অনেকগুলো স্বপ্ন থাকে। স্বপ্ন দেখতে হবে একটা কেন্দ্রীভূত
জায়গা থেকে। থাকতে হবে একাগ্রতা। আর সাহিত্যের জায়গাটা সব সময় কঠিন। কী পেয়েছি, কী
পেলাম না, কে কী বলল তা ভাবলে সাহিত্য হয় না। আমাদের সমাজ লেখকদের কথা চিন্তা করে
না। লেখক লিখেন মনের আনন্দে। প্রচুর লেখা লিখতে হবে। এবং ভালো লিখতে হবে।
শারফিন শাহঃ ধন্যবাদ ও শুভ কামনা ।
Comments
Post a Comment