খ্রিস্টীয়
দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কাল বাংলার ইতিহাসে রাজনৈতিকভাবে যেমন
গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর গুরুত্ব রয়েছে বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে। সামন্তবাদী
শাসনব্যবস্থায় পাল-সেন-বর্মণ কিংবা তুর্কী শাসনের যাত্রা ‘যুগসংক্রান্তি’ নামে
ইতিহাসে ভিত্তি পেলেও এ সময়ের সামাজিক পটভূমিকা রচিত হয়েছিল সিদ্ধাচার্যদের হাতে। হ্যাঁ,
বলছিলাম বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ বা
চর্যাগীতিকা বা চর্যাচর্যবিনিশ্চয় এর কথা।
চর্যাপদ
৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ২৪ জন বৌদ্ধ তান্ত্রিক ও সাধক রচিত এক ধরনের ধর্মীয়
রুপকধর্মী গান। সান্ধ্য বা সন্ধ্যা ভাষায় রচিত এ গ্রন্থে মোট গান বা পদের সংখ্যা
৫১ টি। গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের
রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে এ আশ্চর্য পুঁথি আবিষ্কার করেন এবং ১৯১৬ সালে তাঁর
‘হাজার বছরের বাংলা গান ও দোহা’য় তা গ্রন্থবদ্ধ করেন। পরবর্তীতে ডঃ সুনীতিকুমার
চট্টোপাধ্যায় ও ডঃ মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহর পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা ও যুক্তিতে
চর্যাগীতিকা বা চর্যাপদের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য বিস্তৃতি ছড়ায় বহুগুণ এবং লাভ করে
বাংলা সাহিত্যের সোনালি বীজ হওয়ার গৌরব।
গুরুত্বপূর্ণ
এই সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে বিতর্ক ও দ্বিমতের শেষ নেই। আপাত নিরীহ এ গ্রন্থটির
সঙ্গে এই ভূভাগের ভাষাসমূহের অধিকাংশ প্রধান আধুনিক ভাষার ঐতিহাসিক বিবর্তন যুক্ত
থাকায়,
প্রায় সব ভাষাভাষী পণ্ডিত জাতীয় গৌরবের ভিত্তি থেকে
চর্যাপদকে বিচ্ছিন্ন করতে চাননি । রাহুল সাংকৃত্যায়ন জানালেন এর ভাষা হিন্দি। ডঃ জয়কান্ত মিশ্র
মৈথিলি ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস রচনাকালে ১৯৪৯ সালে দৃঢ়ভাবে বলেন, চর্যাপদ মৈথিলি
ভাষার প্রাচীন সম্পদ। ১৯৬৫ সালে ডঃ
খগেশ্বর মহাপাত্র ‘চর্যাগীতিকা’ ওড়িয়া ভাষার গ্রন্থে চর্যাপদে ওড়িয়া ভাষার
প্রাধান্যের কথা বলেন। ১৯৮১ সালে ডঃ সত্যেন্দ্রনাথ শর্মা আসামের আদিযুগের সাহিত্য
হিসেবে চর্যাপদের নাম উল্লেখ করেন। বলা যায়, এই ঘটনাগুলো আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের জন্য শুভ হলেও নির্মোহ জ্ঞানকাণ্ডের জন্য
হয়েছে ভয়ানক।
চর্যার ২৪
জন সিদ্ধাচার্য বা কবিগণের অল্প কজন বাঙালি ছিলেন। এদের বেশির ভাগই পূর্ব ভারত ও
নেপাল রাষ্ট্রের অধিবাসী ছিলেন। তাঁরা হলেন: কাহ্নপা (১৩টি) , লুইপা (২টি) , কুক্কুরীপা (২টি), বিরুপা (১টি), গুণ্ডরীপা (১টি), চাটিল্লপা (১টি), ভুসূকুপা (৮টি), কম্বলাম্বরপা (১টি), ডোম্বীপা (১টি), শান্তিপা (২টি), মহিত্তাপা, বীণাপা (১টি), সরহপা (৪টি), শবরপা (২টি), আর্যদেবপা (১টি), ঢেন্ঢণপা (১টি),, দারিকপা (১টি), ভাদেপা (১টি), তাড়কপা (১টি), কঙ্কনাপা (১টি), জয়নন্দীপা (১টি), ধর্ম্মাপা (১টি), তান্তী পা (১টি) ও লাড়ীডোম্বীপা। এঁদের মধ্যে লাড়ীডোম্বীর পদটি
পাওয়া যায়নি। ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক
পদগুলি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিতে না থাকলেও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী
আবিষ্কৃত তিব্বতি অনুবাদে এগুলির রচয়িতার নাম উল্লিখিত হয়েছে যথাক্রমে কাহ্ন পা, তান্তী পা ও কুক্কুরী পা।
চর্যাপদগুলো
একাধিক চরণবিশিষ্ট, অন্ত্যমিলযুক্ত
কবিতা এবং সুরসঙ্গের বিচারে গীত। চর্যারপদগুলিতে রাগনামের উল্লেখ রয়েছে। পটমঞ্জরী, মল্লারী, ভৈরবী, কামোদ, বরাড়ী, গুঞ্জরী, গৌড়, রামকেলি, দেশাখ, আশাবরী, মালসী,
অরু, দেবগিরি, ধানশি ও বঙ্গাল। রাগনাম থেকেই সহজেই বলা যায়, এগুলো সুরসহযোগে পরিবেশিত হতো।
প্রতিটি
চর্যার বিষয়বস্তুই দুরূহ দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার আলোছায়ায় রহস্যময়। আধ্যাত্মিক
সাধনা ব্যতিত অন্য উদ্দেশ্যে এ গানগুলো রচনা হয়েছিল কিনা, সে কথা বলা আজ মুশকিল। তবু গান বা পদগুলোর মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজ,
অর্থনীতি, পরিবেশ ও যাপিত জীবনধারার একটি চিত্র ফুটে ওঠে। প্রতীক বা রূপক হিসেবে
লৌকিক জগতের বস্তু ও প্রাণীর যে উল্লেখ
পাওয়া যায়, তা বাংলার মানুষের, সেকাল-একাল, প্রতিদিনের উপজীব্য। সাঁকো, কেডুয়াল, গুণ টানা, দাঁড় টানা, পাল তোলা, সেঁউতি, কাছি, খুণ্টী, উজান বাওয়া প্রভৃতি বারবার চর্যায় উল্লিখিত হয়েছে। ৩৮তম
পদে দেখা যায়-
‘কাঅ ণাবডহি খান্টি মন কেডুয়াল।
সদগুরুবঅণে ধর পতবাল। ।’
সরলার্থ -
কায় [হইল] ছোট নৌকাখানি, মন [হইল] কেরোয়াল।
সদ্গুরু-বচনে পতবাল (পাল) ধর। (অনুবাদ: সুকুমার সেন)
কাহ্নপাদের
একটি পদে সেকালের বিবাহ-অনুষ্ঠানের চিত্র ফুটে উঠেছে। সেযুগের খেলাধুলা, নৃত্যগীত ও আমোদপ্রমোদের চিত্রও চর্যাকারগণ সুপটু হাতে এঁকেছেন। বীণাপাদের
১৭তম পদটিতে আছে–
“নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।
বুদ্ধ নাটক বিষমা হোই।।”
(অর্থাৎ-
বজ্রযান নাচছেন, দেবী গাইছেন আর বুদ্ধনাটক অভিনীত
হচ্ছে।)
এখানে আছে
গভীর ভাবাপন্ন জীবন তত্ত্ব ও উপদেশ। যেমন-
‘পর অপ্পাণ ম ভত্তি করু সঅল নিরন্তর বুদ্ধ।
এহুসো নিম্মল পরম পউ চিত্ত সহাবে সুদ্ধ ।।'
(অর্থাৎ, আপনি ও পরে ভ্রান্তি করিও না; সকলেই নিরন্তর বুদ্ধ, এই সেই নির্মল
পরমপদ্মরূপ- চিত্ত স্বভাবতই শুদ্ধ।)
‘ঘরে আছই বাহিরে পুচ্ছই।
পই দেকখই পড়িবেসী পুচ্ছই।।'
(অর্থাৎ, ঘরে
যে আছে তাকে বাইরে কী খোঁজ কর? আগে ঘর না
দেখেই প্রতিবেশীদের কী জিজ্ঞেস কর?)
বাংলা ভাষার
তখন শৈশবকাল। স্বভাবতই বিষয়বস্তুর দিকে যতটা মনোযোগ ছিল, ততটা ছিল না ভাষাবিন্যাস
বা ছন্দের নির্ভুলতায়- যদিও অনেকে একে পয়ার কিংবা মাত্রাবৃত্তের প্রথম প্রয়াস বলে
মানেন। আদ্যানুপ্রাস ও অন্তানুপ্রাসের বহুল ব্যবহার বইটিকে করে তুলেছে আনন্দপাঠ্য।
উদাহরণ-
‘জিম
জিম করিণা করিণিরে রিসঅ।
তিম
তিম তথা মঅগল বরিসঅ।‘ (চর্যা ৯)
‘গন্ধ
পরস রস জইসোঁ তইসোঁ।
নিন্দ
বিহুনে সুইনা নইসো।।’ (চর্যা ১৩)
যেকোনো
ভাষার আদি নিদর্শন কবিতা। তবে বেশির ভাগ ভাষায়ই প্রারম্ভে কবিতা হলেও তা মূলত
আখ্যান বা গাথানির্ভর ছিল। গোটা ইউরোপের কোনো ভাষায়ই উষালগ্নের লিরিক কবিতায় এর
সমতুল্য নজির নেই। ইউরোপের অন্যান্য ভাষায় রচিত প্রাচীন কাব্য নিদর্শনের সঙ্গে
চর্যাপদের আরো একটি পার্থক্য এই যে ইউরোপীয় প্রাচীন কবিতাগুলো যেখানে যুদ্ধ, অভিযান কিংবা প্রেমাশ্রয়ী; চর্যাপদ সেখানে প্রেম নয়, বরং শরীরী
অভিব্যক্তিকে আশ্রয় করেছে তান্ত্রিক সাধনার উপায় হিসেবে।
বাংলা
সাহিত্যের সোনালি এই বীজ বৃক্ষ হয়ে উঠুক আর তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময় ।
Comments
Post a Comment