মাঝে মাঝে আমাকে যখন রাজধানীর বাসগুলোতে চড়তে হয়, একটি ব্যাপার আমার খুব অদ্ভুত লাগে। প্রায় শ’খানেক মানুষ একসাথে যাচ্ছে, অথচ কারও সাথে কারও কোন কথাবার্তা নেই। একজন মানুষ এ শহরে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে নিভৃতে, অনাদরে। উষ্ণ তার কপালে হাত রাখবে এমন কেউ নেই। কিংবা বলা চলে কারও কোন সময় নেই কারও দিকে তাকানোর। ‘রুটিন মাফিক চলে তারা/ রুটিন মাফিক খায়।’ কিন্তু উপন্যাসের পাতায় যখন পড়ি,
‘ জমির সাহেব ভাবছে সে
একা।
শাহানা ভাবছে সে একা।
সবাই একা।
ছেলে একা।
মেয়ে একা।’
তখন থমকে দাঁড়াতে হয়, একি
আমার, আমাদের সবার কথা নয়? জটিল নাগরিক বর্তমানের প্রতিলিপি নয়?
হ্যাঁ, পড়ছিলাম হিলারিয়াস
হিমেলের প্রথম উপন্যাস ‘স্বর্গ নরকের সহবাস’।
শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজের
আর আর প্রভাবের মধ্যে মানবীয় সম্পর্কের কৃত্রিমতা ও পারিবারিক বন্ধন হ্রাস সবচেয়ে
প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে একবিংশ শতাব্দীতে। স্বর্গ নরকের সহবাস উপন্যাস সে সত্যকে অনুপুঙ্খভাবে চিত্রিত করেছে।
নাগরিক জটিলতা, অবিশ্বাস, যান্ত্রিকতা ও অর্থমগ্ন যাপিত জীবনযাত্রা কেড়ে নেয় জীবনের
গুঢ় লক্ষ্য আনন্দ আর ভালবাসা।
মূল ঘটনা এরকম। জমির
সাহেব ও শাহানা ৩৭ বছরের দাম্পত্য জীবন শেষে প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসায় খুঁজতে থাকে
পরস্পরের জীবনের দেনা পাওনা। স্মৃতিচারণ ও আরও কিছু চরিত্র জুটি যেমন শফিক-সাথি,
তৌকির-মিম ও ইকরাম-সেঁজুতির সম্পর্কের বয়ান ও বিশ্লেষণ তাঁদের জীবনের নতুন এক অর্থ
দাঁড় করিয়ে দেয়। আনন্দে ভরে উঠে তাঁদের জীবন।
ঝকঝকে ছাপা এক সুখপাঠ্য
উপন্যাস। নারীবাদ ও সমাজ সচেতনতার সমকালীন বিবর্তনেরও খোঁজ পাওয়া যাবে এতে। লেখকের তীক্ষ্ণ লেখনীর সাথে আগেই পরিচিত ছিলাম।
কিন্তু প্রথম উপন্যাস স্বত্বেও লেখায় পরিণতি বিস্ময়কর। সবচেয়ে ভালো লেগেছে
বক্তব্যের নানা আঙ্গিক বিশ্লেষণ, যা লেখকের অমিত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্পষ্ট
নির্দেশক। এপিগ্রামগুলোও মনে রাখার মত।
‘যে বুঝে নেয় না, তাকে
বোঝানো যায় না’
‘আবেগ জেগে উঠলে মানুষ
নিজেরাই জানায়’
‘জীবনকে হারিয়ে জীবনকে কি
নির্মাণ করা যায়?’
‘অল্প দিনের বেশ্যাদের
আমরা ঘৃণা করি আর দীর্ঘ দিনের বেশ্যাদের সম্মান করি’
লেখক ও বইয়ের জন্য শুভ
কামনা।
বইয়ের নামঃ স্বর্গ নরকের
সহবাস
লেখকঃ হিলারিয়াস হিমেল
প্রকাশকঃ জয়তী
প্রচ্ছদঃ শতাব্দী জাহিদ
মূল্যঃ ১৫০ টাকা
Comments
Post a Comment