Skip to main content

কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন ভ্রমণ লিপি



‘‘না, তোকে যেতেই হবে’’ নানা অজুহাত দেখিয়ে যতই বলছিলাম এই ট্যুরে সম্ভবত আমার যাওয়া হচ্ছে না, ততই বন্ধু আলাউদ্দিনের চাপ বেড়ে চলছিল। শেষ পর্যন্ত যদিও রাজি হয়েছি, চিন্তায় ছিলাম কতটা জমে উঠবে ট্যুর- কেননা সময়সংক্রান্ত জটিলতা, আসন্ন বিসিএস পরীক্ষাসহ নানা কারণে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল কম। শেষ মুহূর্তে গিয়ে জানতে পারলাম ৮ জন শিক্ষকের জায়গায় শিক্ষক যাচ্ছেন মাত্র ৩ জন। আদতে তখন কল্পনাই করি নি, এই ট্যুর মিস করলে আনন্দের অনেকগুলো উপলক্ষ্য-উপাদান মিস হয়ে যেত, ক্ষুদ্র জীবনের সবচাইতে আনন্দময় ও স্মরণীয় দিনগুলোর কয়েকটি হয়ে যেত হাতছাড়া!

গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৯ থেকে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সবুজ ক্যাম্পাসে জড়ো হতে লাগল ৮ম ব্যাচের উদ্দীপ্ত কিছু তরুণ-তরুণী। উদ্দেশ্য— সকলের বহুকাঙ্ক্ষিত শিক্ষাসফর ২০১৯ (কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন-ছেঁড়া দ্বীপ)। আমাদের অভিভাবক হিসেবে যাত্রাসঙ্গী হচ্ছেন অধ্যাপক ড. রবিউল ইসলাম স্যার, অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী স্যার ও ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাহমিনা আক্তার। জোবায়ের ও তবিবের সুদক্ষ ব্যবস্থাপনায় লটারির ভিত্তিতে সকলে পেল বাসে যার যার আসন। অবশ্য দীর্ঘ ভ্রমণের বাস হিসেবে বরাদ্দকৃত বাস নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ পেল কয়েকজনের মন্তব্যে। কিন্তু সাড়ে দশটা নাগাদ বাস ছেড়ে দিলে সম্ভাব্য আনন্দের উচ্ছ্বাস সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের বাস যে গতিতে এগোয়, তার চেয়ে বেশি জমে ওঠে বাসভর্তি যাত্রীর গান ও তির্যক ভঙ্গীর রসাত্মক আলাপ।
কুমিল্লা কেন বাংলাদেশে আলোচিত- এই নিয়ে বেশ সরস বাক্যের আদান-প্রদান হলেও আমাদের যাত্রাবিরতি ও মধ্যরাতের নাস্তা সারতে হয় কুমিল্লাতেই—পদুয়ার বাজারের ঝম ঝম রেস্টুরেন্টে। সব মিলিয়ে প্রায় দশ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আমরা আমাদের প্রথম গন্তব্য কক্সবাজারে পৌঁছে যাই। সময় তখন সকাল সাড়ে সাতটা। ঝটপট নাস্তা ও ক্ষণেক বিশ্রাম শেষে বেরিয়ে পড়ি বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য সন্ধানে যা কিনা কক্সবাজার শহর থেকে বদরমোকাম পর্যন্ত একটানা ১৫৫ কিলোমিটার (৯৬ মাইল) পর্যন্ত বিস্তৃত।
হোটেলের কাছেই কলাতলী বীচ। একপাশে হাঁটতে হাঁটতে আরেক বীচ সুগন্ধায় যাওয়া যায়। সাগরের তীরে চলল ফুটবল খেলা, রাইডিং, টায়ার ডাইভিং আর ফাঁকে ফাঁকে ক্যামেরার ফিল্মে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা। লাঞ্চের পর হিমছড়ি পার্ক ও ঝর্ণা দেখার উদ্দেশে আমরা ২০১৭ সালে উদ্বোধিত মেরিন ড্রাইভ রোডে যাত্রা শুরু করলাম। মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক, যা বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে কক্সবাজারের কলাতলী সৈকত থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বর্তমানে পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক। একপাশে সবুজ পাহাড়, আরেকপাশে নীল সমুদ্র । মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে দীর্ঘ পিচ ঢালা মসৃণ পথ । এ যেন পাহাড়-সমুদ্রের মিতালির মাঝে বিভেদরেখার ছাপ ।
হিমছড়ি মূলত উচু আকারের একটি পর্বত সারি যেখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ফেনায়িত গর্জন আর সবুজাভ পার্বত্যের সহাবস্থানের অনিন্দ্য দৃশ্যের দেখা মেলে । ঝর্ণাও নাকি আছে একটা, আমি খুঁজে পাই নি। সৈকতের খুব কাছে দেখলাম মাছ ধরার কিছু সাম্পান। পরের গন্তব্য লাবণী বীচে। ব্যাপক আয়তনের এ বালুভূমিতে ক্লান্ত সূর্য ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে- মনে হচ্ছে আমাদের খুব কাছে। সৈকতে আমি আর তবিব হাঁটতে হাঁটতে পস্পরকে হারিয়ে ফেললাম। রক্তাভ জল মনে হয় শুষে নিল দিনের সমস্ত আলো। কথার ঝুরি আর এলোমেলো আড্ডায় শেষ হয়ে এল আমাদের প্রথম দিন।

দ্বিতীয় দিন আমরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পৌঁছলাম-- টেকনাফ থেকে লঞ্চে চড়ে। আমার প্রথম লঞ্চ ভ্রমণ। উত্তেজনা বেশ ছিল। সিট ভাড়া করলেও বসে থাকে নি কেউ। দেখেছে কেবল দুপাশের নীল জল, নাফ নদী আর নদীর ওপারে মিয়ানমারের আরাকান। সিগালগুলো খাবারের লোভে ছুটে যায় আমাদের সঙ্গে অনেকখানি পথ। কেউ তাদের চিপস আর বিস্কুট খাইয়ে আর বাকিরা আনন্দ পায় দেখে।
সেদিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছেঁড়া দ্বীপে হাঁটাহাঁটি আর সূর্যাস্ত দর্শন। ছেঁড়া দ্বীপ যদিও সেন্ট মার্টিন দ্বীপেরই একটি অংশ, নৌকায় করে যেতে সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক। মাত্র ৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই দ্বীপে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানায় জমি কেনা, এমনকি কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ আইনত নিষিদ্ধ। গাঢ় নীলের মাঝখানে প্রবাল, কাঁকড়া আর কেয়াবনে জড়ানো ছেঁড়া দ্বীপ আমাদের ধরে রাখল গোধূলি অবধি।
তৃতীয় দিন দুপুর পর্যন্ত সময়টা কেবল সেন্ট মার্টিনকে নানান আঙ্গিকে দেখার পালা। প্রায় ৫০০০ বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল জায়গাটি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নিচে চলে যায়।এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া জেগে উঠে। এর ১০০ বছর উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে উঠে। এক গবেষণায় তথ্য মেলে, প্রায় ২৫০ বছর আগে আরব বণিকদের নজরে আসে এ দ্বীপটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্যের সময় আরব বণিকরা। এ দ্বীপটিতে আরব বণিকরা বিশ্রাম নিতো। তখন তারা এ দ্বীপের নামকরণ করেছিল 'জাজিরা'। পরবর্তীতে যেটি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত হয়। বর্তমানে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় দেড় লাখ নারকেল গাছ আছে। আরও জানলাম, এখানকার বেশিরভাগ ব্যবসায়ী এ অঞ্চলের অধিবাসী নয়।

শেষ দিন। খুব ভোরে সবাই ওঠে পড়ল। খালি পায়ে বালিতে কেউ হাঁটছে দল বেঁধে । কেউ নেমেছে ভাড়া করা সাইকেল নিয়ে। আমি কোনটাই মিস দিলাম না। সাইকেল চালানোর দলে সঙ্গী ছিল দুই বান্ধবী শামিমা আর আফ্রিদা । কোথাও আমাদের নামতে হয়েছিল বালি দেখে, কোথাও থামতে হয়েছিল পাথর দেখে— ছবি তুলতে! পুরো দ্বীপ চক্কর দেয়ার লোভ তাই সামলাতে হয়েছে অনিচ্ছায়- সময়ের অভাবে।
আরেক দফা স্নান আর যৌথ ছবি তোলার হুল্লোড় বয়ে গেল দুপুর অবধি। এখনি ফিরতে হবে- এই বার্তায় লাঞ্চের পর কেউ মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বসে থাকলো হোটেল লাউঞ্জে, কেউ ঝটপট সেরে নিল কেনাকাটা । আটলান্টিকায় করে যখন ফিরছি টেকনাফে, শ্রান্তিতে সবার চোখ তখন ঘুমে ঢুলু ঢুলু। তবু শেষ দেখা দেখা থেকে বঞ্চিত হবে ভেবে কেউ বসে রইল না। জলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখল কেবল জলের নাচন।
বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার বাস থেকে একে একে নেমে পড়ল প্রাণের বন্ধুরা। তবু নাঈমের পায়ের ক্ষত কবে সেরে উঠবে, খবর নিতে হবে। আসার পথে কেন জোবায়ের অভিমান করে বাসের শেষ সারিতে শুয়ে সারা রাত কাটিয়ে দিয়েছে। রবিউল স্যারের ধমক শুনেই পড়বে, মামুন আর সিনথিয়া কোথায় উধাও হয়ে যেত!
ভালবাসা ও অভিমানের শেকলে আজীবন বাঁধা থাকুক ৮ম ব্যাচের প্রাণগুলো!

Comments

Popular posts from this blog

হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০ গান

হুমায়ূন আহমেদ। ১৩ নভেম্বর ,  ১৯৪৮  –  ১৯ জুলাই ,  ২০১২ গদ্যকার, নাট্যকার , চলচ্চিত্রকার ইত্যাদি নানাবিধ পরিচয়ের বহুল প্রচার তাঁর গীতিকার পরিচয়কে ধামাচাপা দিয়ে রাখছে। হুমায়ূন আহমেদ সত্যিকার অর্থে সর্বদিকেই এক যাদুকরের নাম।  ১৩ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা জেনে  নেব  তাঁর লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০  গানের লিরিক্স। সাথে থাকছে ইউটিউব লিংক!   ১। যদি মন কাঁদে,  তুমি চলে এসো  এক বরষায় এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে, জল ভরা দৃষ্টিতে যদি কোমল শ্যামল ছায়।। যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী, কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরী উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো ঝলকে ঝলকে নাচিবে বিজলি আলো।।  নামিবে আঁধার বেলা ফুরাবার ক্ষণে মেঘমল্লার বৃষ্টির মনে মনে কদমগুচ্ছ খোঁপায় জড়ায়ে দিয়ে জলভরা মাঠে নাচিবো তোমায় নিয়ে।।  ভিডিও লিংক-  https://youtu.be/VBS1yyHTxek?list=PLS1Hg7Qpin0RgzvTf6xai0ZDZcxAtENB6 ২। চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে কে আইসা দাড়াইসে গো আমার দুয়ারে। তাহারে চিনি না আমি...

জহির রায়হানের জীবন ও কর্মে বাঙালি জাতীয়তাবাদ

   ‘গুরুমশাই, অন্ধকারে কে দেখাবে মানচিত্রখানা? মাথার মধ্যে দৃশ্য নানা, স্মৃতির মধ্যে অজস্র ফুল, তাঁর সুবাসেই দেশকে পাচ্ছি বুকের কাছে’ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী / দেশ দেখাচ্ছে অন্ধকারে স্মৃতিকে স্মরণে রেখে বুকের মধ্যে দেশকে অনুভব করা ও ক্ষণে ক্ষণে কথায়-কর্মে  তার প্রকাশ ঘটাতে পারা মানুষের সংখ্যা খুব কম- হাতে গোনা। জহির রায়হান সে রকম একজন। শুধু বাংলা চলচ্চিত্র নয় সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে তিনি দেখেছেন দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া বাঙালির কাঙ্ক্ষিত  মুক্তির স্বপ্ন।  বাঙালির ঐতিহ্য-চিন্তা-মনন-দুর্দশা-লিপ্সা নিপুণ তুলিতে যেমন এঁকেছেন উপন্যাস ও গল্পের খেরোখাতায়, তেমনি বন্দী করে রেখেছেন তার চলমান ছবি সেলুলয়েডের ফিতায়।  বাঙালির স্বাধীনতার জন্য তিনি দেশান্তর হয়েছিলেন, হন্যে হয়ে বিশাল ভারতের বিশাল জনসমুদ্রে হেঁটে বেড়িয়েছেন, আন্তর্জাতিক সমাবেশে জনমত গড়ে তুলেছেন এবং ঘরে অসুস্থ স্ত্রী ও পরিবারকে অভুক্ত রেখে উপার্জিত অর্থ বিলেয়ে দিয়েছেন ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য।  বাংলা চলচ্চিত্রের নান্দনিক স্থপতি হিসেবে বাংলা সংস্কৃতিকে যেমন তিনি দিয়েছেন স...

কামরুল কাইসের ১০ কবিতা

১. মহামারি  স্থির সময় অথির বেগে দ্যাখায় যেন অসময়ের ফল। ২. মিতালি ওসব কথা থাক- একটু নিবিড় চঞ্চু তোমার নদীর যেন বাঁক। দৃশ্যে মাখো কালি‌ - তীরে বসে দেখছি নদী দিচ্ছি শিস আর তালি। দন্তসমেত হাঙর ছোটে করাল স্রোতে তোর আমি ডাকি শান্ত দোয়েল  তাতেই নষ্ট ভোর! আজকে এসব রাখ- অল্প কথার কথকতা দূর মিলিয়ে যাক। ৩. প্রাপ্তি মেঘের কান্না দেখব বলে আকাশে তাকিয়েছিলাম নেই, নেই কান্না শুধু এ মনেই। ঊষরতা পাবো বলে মরুভূমি চেয়েছিলাম নেই, নেই ফুল ফোটা সবখানেই। কাকে ছোঁব বলে যেন হাত বাড়িয়ে ছিলাম নেই, নেই রয়ে গেছে সে চির ভাবনাতেই। ৪. স্বাধীনতার সনেট ভেসে ছিল দেশ যবে শোণিত ধারায়, আর্তের ক্রন্দনে ছিল স্পর্শ বেদনার। পাখির সুরেলা কণ্ঠ বন্ধ ছিল হায়! হৃদয়-রক্ত ক্ষরণে বাংলা নিঃসাড়, রবির কিরণ নেই ঊষা-নীলিমায়, আকাশে ভাসল ধোঁয়া বারুদ বোমার পান্থ শ্রান্তি সারল না অশ্বত্থ ছায়ায়- অপরাহ্ণে নেমে এল নিকষ আঁধার! মাঠের সবুজতায় রক্তিম পরশ স্বাধীন প্রাণ স্পন্দন এলো অবশেষে- কণ্ঠে জাগাল সংগীত সপ্তসুর এসে! চেতনার রন্ধ্রে পূর্ণ গভীর হরষ উচ্ছসি হল উদ্ভাস। আজো বহমান। স্বাধীন-তটিনী-ধারা, হবে না প্রয়াণ। ৫. অপহৃত আকাশ যদি না কখনো গোধূ...